বাংলায় তিনটি সাগর প্রবাহিত। দুইটির উৎস্ থেমে গেছে কিন্তু ধারা চলছে। এই দুই সাগর হচ্ছেন সাগর সেন ও সাগরময় ঘোষ। একজন সঙ্গীতের দিকপাল, আরেকজন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমানদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, পশ্চিমবঙ্গের দেশ পত্রিকার তিন দশকের বেশি সময়ের সম্পাদকসহ অর্ধশতাব্দীকালের সফল কর্মী। বাংলা সাহিত্যের বাঘ খ্যাত এই মানুষটির প্রশ্রয় ও ছায়ায় বড় বড় লেখক তৈরি হয়েছেন। এই বড় লেখকের তালিকায় সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীর মতো অনেকেরই নাম উচ্চারণ করা যায়।সাগর সেন ষাটের দশকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস ও চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক জ্বলে ওঠা কন্ঠস্বর। এক আলাদা স্বর ও কণ্ঠের যাদু তিনি নিয়ে আসেন রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুরাগীদের সামনে। তার জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়, আর সাগরময় ঘোষের জন্ম কুমিল্লায়। দেশ বিভাগের বাস্তবতায় এক পর্যায়ে এসে এই দুইজন ভারতীয় হয়ে গেছেন। তাদের প্রতি ভালোবাসা গর্ব সবই আছে আমাদের।
আরো এক সাগরের গর্বে গর্বিত বাংলাদেশ। তিনি ফরিদুর রেজা সাগর। এদেশের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতির এক নিবিড় পৃষ্ঠপোষক। তার যা বয়স ঠিক একই বয়স তার চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও লেখালেখি জীবনের। অর্থাৎ জীবনে বুঝতে শেখার সূচনা থেকেই সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বিচিত্র পথে তার অবাধ বিচরণ। বলা যায় জীবনের চলার পথটিই বাঁধানো শিল্প সংস্কৃতির মনিমুক্তোয়।
‘ফরিদুর রেজা সাগর জীবন ও গ্রন্থপঞ্জি’ গ্রন্থের সংকলক ও সম্পাদক আহমাদ মাযহার প্রসঙ্গ কথায় বলেছেন: ‘তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন ও বিকশিত হয়েছেন যেখানে অর্থনৈতিক উদ্যোগ ছিল সুদূর সাফল্যের স্বপ্ন, তুলনায় সাহিত্যিক ও শৈল্পিক পরিমণ্ডলের উজ্জলতা ছিল বাস্তব। মা বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, বাবা ফজলুল হক এদেশে সিনেমা নির্মাণের আগেই সিনেমাপত্রিকা সম্পাদনার পথিকৃৎ ও নানামুখি সৃষ্টিশীল উৎসাহে কম্পমান স্বাপ্নিক এক মানুষ। হয়তো সেই সূত্রেই ব্যক্তি হিশেবে শিশুকাল থেকেই সাহিত্যিক ও উদ্যোক্তা- এই দ্বৈত সত্তার বিকাশ ফরিদুর রেজা সাগরের জীবনে ঘটেছিল। বর্তমানে তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে দুই সত্তার একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, বরং একটি হয়ে ওঠে অপরটির পরিপূরক।’
এক অদ্ভুত যাদুকরি শক্তিসম্পন্ন মানুষ ফরিদুর রেজা সাগর। নদী কিংবা অসংখ্য জলরাশির স্রোতধারা যেমন মেশে সাগরে গিয়ে, একই বাস্তবতা তার ক্ষেত্রেও। তিনি নিজে শিল্প উদ্যোক্তা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের সফল কারিগর, বিপণন ও বাণিজ্যের এক কিংবদন্তীতুল্য সার্থক কর্মবীর। অন্যদিকে তিনি কোমল হৃদয় শিশুর চেতনার সঙ্গে মিশে যাবার উপযুক্ত এক মানুষ। অদ্ভুত গদ্যচিন্তা তার। যা কিছু দেখেন সহজ ও সুন্দরের ভেতর দিয়ে দেখেন। তাই বর্ণনার শেষে গিয়ে তার দেখা বিষয়টি বিস্ময়কর ঘটনা হয়ে ওঠে। জগৎ সংসারে এমন কিছু যাদুকরি চরিত্র হয়তো থাকে, কিন্তু সে চরিত্রের বিকাশটি সবসময় হয়ে ওঠে না। ফরিদুর রেজা সাগর দারুণ অনুকুল প্রতিবেশে বিকশিত এক সুন্দর মানুষ। বলা ভালো, পরিবেশটি তিনি গড়ে নিতে পারেন। অদ্ভুত দূরদর্শীতা আছে বলে জীবনের জ্যামিতি কিংবা অংকগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলে যায় কাঙ্ক্ষিত সমাধানে।
বাল্যবেলায় চলচ্চিত্রকার বাবা তাকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন একাধিক চলচ্চিত্রে। কিন্তু তিনি অভিনেতা হননি, বরং হয়ে উঠেছেন অভিনয়হীন এক মানুষ। তার জীবনের প্রতিটি অংশে যাদুর মতো কিছু বিষয় আছে, সেখানে অভিনয় বা সাজানো নাটক আছে এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তার হাত দিয়েই আবার প্রযোজিত হয়েছে অসংখ্য নাটক সিনেমা। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নির্মিত ও স্বত্তাধিকারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা শতাধিক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এসেছে ত্রিশটিরও বেশি ছবির জন্য।
সব বয়সে স্বনামেই খ্যাত হয়েছেন ফরিদুর রেজা সাগর। একসময় ছিলেন কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা ও চাঁদের হাটের সংগঠক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়ির ইতিহাসের গোঁড়াতেও রয়েছে তার নাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের গোড়াপত্তনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদেই টেলিভিশনের বেড়ে ওঠা, টেলিভিশন মানুষগুলোর গতিপ্রকৃতি তার মুখস্ত। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের শীর্ষ মানুষগুলোর সর্বোচ্চ আশির্বাদ তার প্রতি। কারণ, পৃথক পৃথকভাবে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অঙ্গনের ষাট ও সত্তরের দশকের দাপুটে ও শীর্ষ মানুষেরা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে তাকেই শিল্প সংস্কৃতির সবচেয়ে নিরাপদ ও সুনিপুণ চালক বা সংগঠক ভেবেছেন। সাফল্যও দেখে যাচ্ছেন।
ফরিদুর রেজা সাগর ১৯৯৬ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড নামের যে টিভি প্রোডাকশন ক্ষেত্র খুললেন, তা অল্পদিনেই হয়ে উঠলো বাংলাদেশের নতুন ধারার টিভি নাটকের সবচেয়ে সফল উৎপাদন ক্ষেত্র। অভিনয়ের বহু তারকা জন্ম নিলেন, গড়ে উঠলেন টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বহু নির্মাতা, কর্মী, ক্যামেরাম্যান, সহকারি। স্বপ্নে সৃজনে বেড়ে চললো গণমাধ্যমের উপদ্রুত এলাকা। এর ভেতরেই জন্ম নিয়েছে বিশাল শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনীতির একটি বলয়। জন্ম নিয়েছে পেশাদারিত্ব, কুটির শিল্প থেকে গণমাধ্যমের কর্পোরেট সংস্কৃতি, বাঙালিয়ানার নতুন অভিধা। যাতে প্রাণিত হয়েছে দেশের শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত অগণিত মানুষ।
ফরিদুর রেজা সাগর ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের গড়া প্রতিষ্ঠান ইমেপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড যখন চ্যানেল আই চালু করলো তখন তা পরিণত হলো সেই সব মুগ্ধ ও স্বপ্নচারী মানুষের বাতিঘরে। বটবৃক্ষ হয়ে রইলেন ফরিদুর রেজা সাগর। যার মধ্যে নির্মাণের গভীর স্বপ্ন ঘুমিয়ে ছিল, সে জাগানোর সুযোগ পেল বটবৃক্ষের সান্নিধ্যে এসে। যার মধ্যে সামান্য সম্ভাবনা ছিল সেই সুযোগ পেল তা জাগিয়ে তুলতে। স্বপ্নের পরশ পাথর হয়ে দাঁড়ালো চ্যানেল আই। কত মানুষ যে এখানে কপাল ঘষেছে এযাবৎকাল, তার হিসাব নেই। নিন্দুকেরা হয়তো মানতে চাইবে না, তবে স্বীকার করতেই হবে খালি হাতে কেউ ফেরেনি ফরিদুর রেজা সাগরদের স্বপ্ন ক্ষেত্র থেকে।
কেউ কেউ বলেন, তিনি খেয়ালি মানুষ। কেউ কেউ একথার জবাব হিসেবে বলেন, শিল্পের পাগলামিটাই আসলে খেয়াল। এই দেশে টেলিভিশন সংস্কৃতি বা টেলিভিশন কার্যক্রমের পরিধি কতভাবে, কত রঙে যে বিস্তৃত হয়েছে তা বোঝা যায় চ্যানেল আই এর ‘যা কিছু প্রথম যা কিছু নুতন’ এর ফিরিস্তি দেখলে। মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম আর জনকল্যানের বহুমুখি পথ রচনায় চ্যানেল আই অনন্য এক প্রতিষ্ঠান। হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে এখানে ইতিহাসের খোরাক তৈরি হয়ে যায়। এই হাসিখেলার নায়ক ফরিদুর রেজা সাগর। শাদা পোশাকের এক মানুষ। পাঞ্জাবি পাজামায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কাটিয়ে দিচ্ছেন বছরের পর বছর। যার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আনন্দ, কষ্ট, গভীর ভাবালুতা কিছুই বোঝা যায় না মুখ দেখে। কখনো অতি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন না, অস্থিরতায় কাঁপতে থাকেন না, চিন্তায় মুষড়ে পড়েন না। মুখাবয়ব রাঙিয়ে রাখেন উজ্জল এক ঝিলিকে। এই ঝিলিকে প্রতিদিন আত্মবিশ্বাসী হয় দূরের কাছের বহু মানুষ।
ফরিদুর রেজা সাগর একজন তুখোড় গদ্যকার। তিনি যা দেখেন তা থেকে বিস্ময়কর গল্প হয়ে যায়। তার দেখাটি অন্যদের সঙ্গে মেলে না। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে শিশু কিশোরদের জন্য ছোটকাকু সিরিজ ২৫টি, সাহেব সিরিজের ৭টি, গল্প সংকলন ১২টি, উপন্যাস ৩টি, নাটক ৩টি, ইলােস্ট্রশন সিরিজ ৫টি। সাহিত্যিক হিসেবেও বহু পুরস্কার এসেছে তার ঝুলিতে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। গত বছর ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে।
তার সাহিত্যিক জীবনের একটি অতিমূল্যবান কাজ বাংলাদেশে টেলিভিশনের ইতিহাস, পরিচালনা ও কার্যক্রম নিয়ে গবেষনামূলক স্মৃতিকথা। একজীবনে টেলিভিশন, টেলিভিশন আরেক জীবনে, টেলিভিশন জীবনের সঙ্গী গ্রন্থগুলি এদেশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও এর সঙ্গে যুক্ত সব মানুষের স্বর্ণালি স্মৃতিতে ঠাঁসা। এই সিরিজের আরো একাধিক সংগ্রহ রয়েছে। এগুলি দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরকারি পাঠ্য, আগামীর গণমাধ্যম গবেষকদের জন্য আকর গ্রন্থ এবং টেলিভিশনের স্বর্ণালি যুগে যুক্ত মানুষদের জন্য অমূল্য জীবনস্মৃতি। যা সুখপাঠ্য ও শিক্ষার উপাদানে ভরপুর।
ফরিদুর রেজা সাগরের আরো এক অদ্ভুত সাহিত্যকর্ম ‘মানুষের মুখ’ সিরিজের বইগুলি। যে বইগুলি দ্রুত পঠনের মতো। পড়তে পড়তে অদ্ভুত বাস্তবতার সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষের মুখের গভীরে কত কী যে লুকোনো, এসব আমরা দেখি না, দেখতে পাইও না। পাঠক পড়েন নতুন তথ্য পান আর অবাক হন।
আরো বহুকিছু আছে ফরিদুর রেজা সাগরের সমুদ্র সমান কমর্যজ্ঞে। যার কুল কিনারা করতে বহুকাল কেটে যাবে। ততদিনে আরো যোগ হবে বহুকিছু। এই গদ্যময় জীবনের জন্মদিন আজ। রাশি রাশি শুভেচ্ছা আর শুভকামনা তাঁর জন্য।