আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র বলে পরিচিত জার্মানিতেও যে মানুষ কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাচ্ছে না বা সবাইকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তা কিছুটা জানা গেলো জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি জাহিদ আল আমিনের কাছ থেকে—যিনি করোনার সবগুলো উপসর্গ নিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন এবং চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। অবশেষে তার পরীক্ষায় জানা গেছে করোনা নেগেটিভ।
শুধু জার্মানি নয়, ইটালিসহ ইউরোপের অন্যান্য আক্রান্ত দেশ এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও করোনার পরীক্ষা এবং চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সুতরাং এরকম একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশ এবং যেখানে চিকিৎসাব্যবস্থাটি এখনও সেভাবে দাঁড়ায়নি, সেখানকার পরিস্থিতি যে অনেক বেশি ভয়াবহ হবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সীমিত সাধ্য নিয়েই যেসব প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল, তা নেয়া হয়েছে কি না; যেসব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে সেগুলো যথেষ্ট কি না এবং সময় মতো ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয়েছে কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কিছুদিন আগে সরকারের তরফে বলা হলো যে, করোনা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র নাকি বাংলাদেশের কাছে মেডিক্যাল সহায়তা চেয়েছে। কিন্তু পরে এই ইস্যুতে আর কিছু শোনা যায়নি। সঙ্গত কারণেই এই খবর অনেককে বিস্মিত করেছিল। কারণ করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের নিজের প্রস্তুতি নিয়েই যেখানে হাজারো প্রশ্ন, সেখানে সে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কী সহায়তা করবে—সেটি আরও বড় প্রশ্ন।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি কেমন, তার বড় উদাহরণ সিলেটে খোদ একজন চিকিৎসক, যিনি করোনা রোগীকে সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি নিজের জন্যও আইসিইউ সহায়তা পাননি। নিজের চেষ্টায় অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এরপর করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা আর নানাবিধ সংকটের খবরও গণমাধ্যমে আসছে।

২৬ এপ্রিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের নানা সংকটের চিত্র দেখানো হয়। অথচ এই খবরের শেষ অংশে স্বাস্থ্য অধিদদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা রিপোর্টারের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আপনি বললেই তো হবে না, সব ঠিক আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই।’ একই দিন একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম: ‘করোনাভাইরাস সংক্রমন, বরিশালে চিকিৎসাসেবা ভয়াবহ সংকটে।’স্মরণ করা যেতে পারে, শুরু থেকেই সরকার বলছে, সবকিছু ঠিক আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। করোনা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কিন্তু সব প্রস্তুতি সম্পন্নের বাস্তব চিত্র কেমন, তা মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পাশাপাশি বিপত্তি বাঁধিয়েছেন ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’ নামে একশ্রেণির বক্তা, যারা মূলত চটুল কথাবার্তা বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চান; তারা করোনাভাইরাসকে ‘ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর আল্লাহর গজব’ বলে আখ্যা দিয়ে এটি মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করবে বলে আশ্বস্ত করা শুরু করেন। তাতে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে এবং তারা নির্ভার থাকা শুরু করে। একশ্রেণির চিকিৎসকও সোশ্যাল মিডিয়ার এই জনপ্রিয়তার লোভে করোনাভাইরাস নিয়ে নানারকম তথ্য ও তত্ত্ব দেয়া শুরু করলেন এবং কী কী কারণে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের ব্যাপক প্রাণহানির শঙ্কা নেই, তার ব্যাখ্যা করলেন। তারা বললেন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেশি এবং এখানে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা কম বলে করোনা এখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। প্রচুর মানুষ তাতে বিশ্বাস করলো। কিন্তু দেখা গেলো প্রতিবেশী ভারতেই বাংলাদেশের মতো তাপমাত্রা থাকার পরও সেখানে এই ভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেছে। শহরের পর শহর লকডাউন হয়েছে। সৌদি আরবের তাপমাত্রা আরও বেশি। সেখানে পুরো রাজ পরিবারের দেড় শতাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে সবাই যে বৃদ্ধ, তাও নয়। কিন্তু বাংলাদেশের একশ্রেণির বক্তা ও চিকিৎসকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে দেশের মানুষ এই ভাইরাস নিয়ে খুব একটা ভীত না হয়ে নির্ভার ও নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করলো।
তথ্য ও তত্ত্বের এই বিভ্রান্তি সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও প্রভাবিত করলো। মার্চ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল মোটামুটি রিল্যাকট্যান্ট। যেন বেশি কিছু হবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবারই বিমানবন্দর বন্ধ করা, বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ইটালি থেকে যাতে কেউ আসতে না পারেন, সেজন্য সরকারের উপর নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করা হলেও, সরকার তাতে কান দেয়নি। বরং দলে দলে লোক এসেছেন। শুধু তাই নয়, বিমানবন্দরে তাদের পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি। এমনকি নিয়ম অনুযায়ী তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়নি। অথচ যখন পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলো তখন সেই বিদেশফেরত লোকগুলোকেই হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজা শুরু করলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখানে সমস্যাটা প্রস্তুতির নাকি পরিকল্পনার?
বাংলাদেশে এটা বাস্তবতা যে, সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক এবং সব বিষয়ে তাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হয়। কিন্তু দেশের সব টেলিভিশনে চোখ রাখা, সব পত্রিকা পড়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত নজর রাখা, সারা দেশের ৬৪টি জেলার আনাচে-কানাচে কোথায় কী হচ্ছে তার সবকিছু নখদর্পনে রাখা একা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অসম্ভব। তাহলে তিনি সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে নেন? তার কাছে যেসব তথ্য যায় বা তাকে যেসব তথ্য দেয়া হয়, তারউপর ভিত্তি করে তিনি একটা পরিকল্পনা তৈরি করেন। প্রশ্ন হলো সব সময় প্রধানমন্ত্রীকে কি সঠিক তথ্যটি দেয়া হয়? শোনা যায়, বিভিন্ন বিষয়ে তাকে তথ্য দেয়ার দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা পারতপক্ষে সমস্যার কথা বলেন না। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, সবকিছু ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই। যেমন সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী যখন বরগুনার সিভিল সার্জনকে জিজ্ঞেস করলেন, নদীমাতৃক এলাকা হওয়ায় সেখানে নৌ অ্যাম্বুলেন্স লাগবে কি না, সিভিল সার্জন বললেন লাগবে না। কোনো সমস্যা নাই। যখন প্রধানমন্ত্রী আবার তাকে যুক্তি দিয়ে বললেন, তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ হলে ভালো হয়। তার মানে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকগুলো জানেই না কোন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে কী বলতে হয় এবং কীভাবে কাজ আদায় করে নিতে হয়। বরং প্রধানমন্ত্রী উল্টো তাদের বলছেন যে, এটা লাগবে।
আমলাদের মধ্যে মূলত যে প্রবণতা কাজ করে তা হলো, তারা আজ এক মন্ত্রণালয়ে আছেন, তো কাল আরেক জায়গায় যাবেন। পরশু বদলি হয়ে মোটা অংকের পেনশন নিয়ে রাজার হালে অবসর জীবনযাপন করবেন। খামাখা বেশি কথা বলে বা বেশি সমস্যা চিহ্নিত করার দরকার কী? চাকরির মেয়াদটা ভালোয় ভালোয় পার করে দিতে পারলেই হয়। কিন্তু প্রধামন্ত্রী নিজেও জানেন, এভরিথিং আন্ডার কন্ট্রোল কোনোকালেই ছিল না বা থাকেও না। কিন্তু সেটি জানলেও তিনি তথ্যের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে যখন বলা হয় যে, কোনো অসুবিধা নাই অথবা সমস্যা খুব গুরুতর নয়, তখন তিনি একভাবে প্ল্যান করেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পরিস্থিতি যদি খারাপ হতে থাকে এবং তাকে দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মধ্যে যদি বিস্তর ফারাক থাকে এবং তিনি যদি সেটা কোনো না কোনোভাবে বুঝে যান, তখন শেষ মুহূর্তে তার পক্ষে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়ে। করোনা ইস্যুতেও আমার ধারণা, শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সব তথ্য সঠিকভাবে দেয়া হয়নি বা তার কাছে তথ্য গোপন করা হয়েছে। অথচ আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যতটা চিনি, তিনি প্রকৃত সমস্যা জানতে চান। কিন্তু তাকে অনেক কিছুই সময়মতো এবং আসল তথ্য দেয়া হয়নি। সুতরাং এখন করোনা ইস্যুতে আমরা যেসব প্রস্তুতির অভাবের কথা বলছি, সেটি আসলে তথ্যের শূন্যতা।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটা থিওরি—‘যে দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।’ অর্থটা হলো এই যে, যখন সংবাদমাধ্যম স্বাধীন থাকে এবং সঠিক তথ্য জনগণ ও নীতিনির্ধারকরা জানতে পারেন, তখন যেকোনো সংকটের সমাধানে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়। কোনো এলাকায় খাদ্য সংকট রয়েছে কি না তার শঙ্কা আছে কি না, তা যদি সাংবাদিকরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন, তাহলে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ। ফলে দুর্ভিক্ষের মতো সংকটের শঙ্কা সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যটি সঠিক জায়গায় পৌঁছানো যে জরুরি—অমর্ত্য সেনের তত্ত্বের এটিই সারকথা।
তবে তথ্যশূন্যতা কেবল যে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, বরং সবচেয়ে বেশি তথ্যশূন্যতা ও তথ্যবিভ্রান্তি তৈরি করা হয় গণসচেতনতার পর্যায়ে। করোনা ইস্যুর শুরু থেকেই আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন ও তথ্য দিয়েছেন, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তাতেই বোঝাই যায়, এসব কথা ও তথ্যে বিশাল জনগোষ্ঠীর কোনো আস্থা নেই। কারণ তাদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে অনেক সময়ই বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। করোনা ইস্যুতে কোনো তথ্য গোপন না করার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বলেছে, জনগণকে সঠিক তথ্য না দেয়াটা হবে চরম ভুল।
সুতরাং করোনাভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তথ্যশূন্যতার যে ভয়াবহ চিত্রটি দেখিয়ে দিলো, ভবিষ্যতে এরকম বিপর্যয় ও বিপদের সময় এই শিক্ষাটা কাজে লাগানো গেলেই সার্থক। না হলে করোনাভাইরাসের চেয়ে ছোট বিপদের পরিণতিও হবে অনেক ভয়াবহ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
