বিএনপি নেতারা শুধুমাত্র কারচুপির অভিযোগ করে যতই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন না কেন নির্বাচনে ‘বাংলাওয়াশ’ হওয়ার পেছনে তাদের নিজেদের ব্যর্থতাই ছিলো সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং প্রত্যেকটি সেক্টরেই they were simply outplayed. শুরু থেকেই এই নির্বাচনকে তারা সিরিয়াসলি ‘ভোটযুদ্ধ’ হিসেবে নেননি। তাদের মনোনীত প্রার্থীদের গা ছাড়া ভাব নেতাকর্মীদের মাঝে পারেনি কোনো উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে।
এছাড়া কাজ করেছে আরো কিছু অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার বোকামীটুকুও। যেমন-
১. জামায়াত নির্ভরশীলতা
দেশজুড়ে অসংখ্যবার আলোচনা সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার পরেও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের জামায়াত মোহ কাটেনি। বিগত ১০ বছর ধরেই প্রতিটি ‘ঈদের পরে আন্দোলন’ তারা ডাক দিয়েছিলেন জামায়াতের ক্যাডারদের পেশীশক্তির উপর নির্ভর করেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই জামায়াত ক্যাডাররা মাঠেই নামেনি। কিন্তু তাতেও মোহমুক্তি ঘটেনি বিএনপি নেতাদের। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর যে একটি ব্যাপক নেতিবাচক ইমেজ রয়েছে দেশবাসীর মাঝে সেটি অনুধাবনের চেষ্টাও করেনি বিএনপি নেতৃবৃন্দ। যে কারণে আওয়ামী লীগের ‘নতুন প্রজন্মের ভোট, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে হোক’ স্লোগানকে পাত্তা না দিয়ে তারা ২৫ জন জামায়াত নেতাকে ধানের শীষে নির্বাচন করার সূযোগ প্রদান করেন। যেটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নতুন প্রজন্মের মাঝে।
শুধু জামায়াত নয় বঙ্গবন্ধুর খুনীর স্ত্রী রিটা রহমানকে পর্যন্ত মনোনয়ন দিয়েছে তারা। যা ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দেড় কোটি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের মাঝে। শাহবাগের গর্জনের ঢেউয়ে আলোড়িত এই প্রজন্মের মানসিকতা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন তারা। ফলে নবীন প্রজন্ম ও মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের থেকে।
২. ভাড়াটিয়া নেতৃত্ব
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে থাকায় এবং তারেক রহমানের ব্যাপক নেতিবাচক ইমেজের কারণে নেতৃত্ব সংকটে ভোগা বিএনপি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ভাড়াটিয়া নেতৃত্বের উপরে। ড. কামাল, ডা. জাফরউল্লাহ, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকীর মতো অন্যান্য দল হতে আগত নেতাদের উপরই নিজ দলের নেতাদের চেয়েও বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। কিন্তু এই নেতাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আরো বেশী নাজুক করে তোলে তাদের অবস্থান।
প্রথমত: দেশীয় রাজনীতিতে এসব ভাড়াটিয়া নেতাদের কারো তেমন কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ইমেজ নেই অনেক আগে থেকেই। ড. কামাল ‘খামোশ’ বলে সাংবাদিকদের আর ‘জানোয়ার’ ডেকে ক্ষেপিয়ে দিলেন পুলিশ বাহিনীকে। টকশোতে অশালীনভাবেই সাংবাদিকদের উপরে চড়াও হলেন আ স ম রব। ডা. জাফরউল্লাহর এলোমেলো অসংলগ্ন বক্তব্য দেশজুড়েই হাস্যরসের জন্ম দেয়। ব্যাপক ট্রল হয় এসব নিয়ে।
মাহমুদুর রহমান মান্নার ঔদ্ধতপূর্ণ মাস্তান মার্কা আচরণ চরম বিরক্তির জন্ম দেয় সচেতন মহলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার পরিকল্পনা ফাসের পর হতেই ব্যাপক ইমেজ সংকটে ভোগা এই ব্যক্তিটির বেপরোয়া কথাবার্তা ক্ষুব্ধ করে তোলে অনেককেই। আর এতো এতো ভাড়াটিয়া নেতাদের মধ্যে ‘কে হবেন সরকার প্রধান?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতেও ব্যর্থ হন বিএনপি নেতারা।
যুদ্ধ জেতার জন্য দেশপ্রেমিক সিপাহী প্রয়োজন, ভাড়াটিয়া মার্সিনারী দিয়ে যে লড়াই জেতা যায় না এই সহজ কথাটাই বুঝতে ব্যর্থ হন বিএনপি নেতারা। ফলাফল তাই এই বিপর্যয়। লোভে পড়ে আসা ভাড়াটিয়ারা যে আরো বেশী লাভের সন্ধানে পেছন থেকেই উল্টো ছুরি মেরে দিতে পারেন, এই সহজ সত্যটা বিএনপি নেতারা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন
৩. আইএসআই সংশ্লিষ্টতা
আইএসআই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৯৩ হাজার সৈনিক সহ বিশ্বের সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় বরণ করে পাকবাহিনী আর জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কখনোই মেনে নিতে পারেনি এই কুখ্যাত সংস্থাটি। তাই এদেশের জন্মলগ্ন থেকেই একের পরে এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে শুরু করে তারা, যাতে এদেশকে অস্থিতিশীল করে দেয়া যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বিডিআর বিদ্রোহসহ অসংখ্য ঘটনার সাথে আইএসআই এর সংশ্লিষ্টতার কথা একাধিকবার পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এবারও নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের তৎপরতা, বিশেষ করে তারেক রহমান, খন্দকার মোশাররফসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতার লন্ডন আর জেদ্দাতে যোগাযোগের খবর ফাস হয়ে পড়ে। যা প্রচারিত হয় প্রায় সবগুলো ইলেকট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়ায়। এর ফলে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। শাহবাগের উত্তাল স্রোতে গর্জে ওঠা এই নবীন প্রজন্মের চাওয়া পাওয়ার গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন বিএনপি নেতারা। পাকি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তালিকা অনুযায়ী ৩০০ আসনে প্রার্থীও মনোনয়ন দেয় তারা। ফলে তরুণ প্রজন্মও মুখ ফিরিয়ে নেন তাদের থেকে।
৪. নির্বাচনী প্রচারণা
আওয়ামী লীগ নেমেছিল জয়ের লক্ষ্য নিয়েই। সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের নির্বাচনী প্রচারণার স্টাইল দেখেই। ফেরদৌস, রিয়াজ, জাহিদ হাসানের মতো অসংখ্য প্রথমসারির জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের নৌকার পক্ষে চমকপ্রদ প্রচারণা রীতিমতো আকর্ষণ সৃষ্টি করে তাদের ফ্যানদের মাঝে। ক্রিকেটার মাশরাফির মনোনয়নে দেশের অগণিত ক্রিকেট প্রেমী জনগণ উল্লাস প্রকাশ করেন।
ঐক্যফ্রন্ট এর পক্ষ থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের মনোনীত করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা অনলাইনে জনপ্রিয় অধিকাংশ ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিস্ট সরাসরি অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের পক্ষে। কারণ তারা প্রায় সকলেই ছিলেন শাহবাগের চেতনায় বিশ্বাসী এবং যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে কট্টরপন্থী। অফলাইনে পোস্টারে, ব্যানারে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারণার ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট ছিলো অনেকাংশেই ম্রিয়মাণ।
নির্বাচনে এটিও একটি বিশাল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আর প্রচারণার শুরুতেই ‘খামোশ’ হুংকার দিয়ে সাংবাদিক সমাজের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেন ড. কামাল। যার মাশুল স্বভাবতই গুণতে হয় ঐক্যফ্রন্টকে কড়য় গণ্ডায়। পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা আর ভোটের সময়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানোর লক্ষ্যে বিএনপি নেতাদের ফাঁস হওয়া ফোনালাপগুলো ব্যাপক হারে প্রচারিত হয় টিভি চ্যানেল আর সোশাল মিডিয়াতে। ফলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয় দেশজুড়ে।
৫. ধর্মীয় জুজু
অতীতে বিএনপির নির্বাচন প্রচারণার অন্যতম অংশ ছিলো হিন্দু এবং ভারত বিদ্বেষী ব্যাপক প্রপাগান্ডা ছড়ানো। ‘আওয়ামী লীগ আসলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে’, ‘মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে’ মার্কা এসব প্রচারণা চালাতে এবার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় তারা। উপরন্তু কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদান করে কওমি পন্থী আলেম সমাজের ব্যাপক সমর্থন পায় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনাকে দেয়া হয় ‘কওমি জননী’ সম্মাননা। ফলে বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ‘ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট’ ব্যবহারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় তারা। ফলাফল ‘ভাড়ে ভবানী’।
নির্বাচন শেষ। স্মরণকালের সর্বোচ্চ বিজয় নিয়ে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। ইতোমধ্যে চীন, ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা, ইরানসহ বিশ্বের শক্তিধর এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের প্রধানগণ শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তাও দিয়েছেন। কাজেই নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্ন তুলে আন্দোলনের পথও রুদ্ধ বিএনপি-জামায়াতের সামনে।
সবদিক বিবেচনা করে বলাই যায়, ঐক্যফ্রন্ট হ্যাভ জাস্ট মিসড দ্য বাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)