চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

‘মানসম্পন্ন’ বই নির্ধারণের মাপকাঠি কী?

বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ শেষ হয়েছে। বই বিক্রি ও বই প্রকাশের সংখ্যা গতবারের চেয়ে বেড়েছে। একাডেমি এবার চমকপ্রদ এক তথ্য জানিয়েছে ‘মানসম্পন্ন’ বইয়ের। তারা জানাচ্ছে প্রকাশিত সাড়ে চার হাজার বইয়ের মধ্যে ‘মানসম্পন্ন’ বইয়ের সংখ্যা ৪৮৮।

গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদনে আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয়, বিপণন) জালাল আহমেদ জানিয়েছেন, এবার বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৯১টি, যা গতবারের চেয়ে ৯৪৫টি বেশি। গতবার বই প্রকাশিত হয়েছিল ৩ হাজার ৬৪৬টি। নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতা ১ হাজার ৪৭২, গল্প ৭০১, উপন্যাস ৬৪৩, প্রবন্ধ ২৫৭, গবেষণা ১২২, জীবনীগ্রন্থ ১০৭, রচনাবলী ১৫, নাটক ২৩, ভ্রমণ বিষয়ক ৯১, ইতিহাসের ১১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে ৯১টি। এছাড়া নতুন বইয়ের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ক ৭৬টি, রাজনীতি-২২টি, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য- ৩৩টি, রম্য ও ধাঁধাঁ-২১টি, ধর্মীয়- ২৬টি এবং ৪৮টি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শিশুতোষ বই এসেছে ১২৫টি, ছড়ার বই এসেছে ১১২, সায়েন্স ফিকশন ও গোয়েন্দা বিষয়ক বই এসেছে ৬৫টি। এছাড়া অভিধান বিষয়ক বই এসেছে ৭টি এবং অন্যান্য বিষয়ে এসেছে ৪২৪টি বই।

প্রকাশিত সাড়ে চার হাজার বইয়ের বিষয়ে বাংলা একাডেমি মাত্র ৪৮৮টি বইকে ‘মানসম্পন্ন’ আখ্যা দিয়েছে, অর্থাৎ ৪১০৩টি বই বাংলা একাডেমির দৃষ্টিতে মানোত্তীর্ণ নয়। ‘মানসম্পন্ন’ বই বিষয়ে জালাল আহমেদের বক্তব্য, “বাংলা একাডেমির একটি কমিটিকে নিয়ে নতুন বইয়ের স্টলে আসা বইগুলো পরীক্ষা করে আমরা প্রাথমিকভাবে মান নিরূপণের চেষ্টা করেছি।” একাডেমির ‘মানসম্পন্ন’ বইয়ের সংখ্যা নিরূপণ বাস্তবতা বিবেচনায় কতখানি সম্ভব সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে স্বাভাবিকভাবেই।

বাংলা একাডেমি ‘মানসম্পন্ন’ বই নির্ধারণে কোন নীতিমালা প্রকাশ করেনি, প্রকাশ করেনি কারা এবং ঠিক কতজন ছিলেন ওই মান নির্ধারণের দায়িত্বে। তবু তারা ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে তেমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। এটা অবাক করা বিষয় সন্দেহ নেই।

একাডেমি কর্তৃপক্ষ যখন অফিসিয়ালি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বইকে ‘মানসম্পন্ন’ বিবেচনা করত ঘোষণা দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে এখানে স্বচ্ছতা থাকা আবশ্যক। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় তারা এই মান নির্ধারণ করেছে সেটার আলোচনা হওয়াও জরুরি। তারা যখন কিছু নির্দিষ্ট বইকে ‘মানসম্পন্ন’ বলে ঘোষণা দিচ্ছে তখন আশা করাই যায় বইগুলো পরীক্ষা করে অর্থাৎ পড়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক যে, সাড়ে চার হাজার বই তারা কীভাবে এত দ্রুত পড়ে সিদ্ধান্তে আসলো? মেলার ২৭তম দিনে বাংলা একাডেমি যখন এমন ঘোষণা দিল তখন ধারণা করাই যায় কমপক্ষে আগের দিন অর্থাৎ ২৬তম দিনে তারা সংশ্লিষ্ট ‘মান নির্ধারকদের’ কাছ থেকে প্রতিবেদন পেয়েছে, এবং মান নির্ধারকেরা মেলার শুরু প্রথম দিন থেকেই যদি বই সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন তবে পড়ার জন্যে প্রথম দিনটাও বাদ। মানে দাঁড়াল তাদের হাতে থাকে মাত্র ২৫ দিন। মেলায় প্রকাশিত ৪৫৯১টি বই মাত্র ২৫ দিনে পড়া ও মান নির্ধারণ করে দেওয়া অবাস্তব বাকপটুতা। প্রতিদিন গড়ে ৬৪টি বই পড়া যত বড় টিমই থাকুক না এটা অসম্ভব!

সাহিত্যকে বলা হয় কালে বসে মহাকালের রচনা। কোন সাহিত্য কালের ব্যবধানে টিকবে আর কোনটি টিকবে না সে নির্ধারণের ক্ষমতা কারো নাই। কবি জীবনানন্দ দাশ স্বকালে স্বীকৃত হন নি, তার স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা আর সাহিত্যমূল্য স্বীকার করেছে গতকাল-একাল। তাই বইমেলায় ‘মানসম্পন্ন’ বই নির্ধারণের এমন সিদ্ধান্ত অবাস্তব ও অকল্পনীয়। তাছাড়া বাংলা একাডেমি নিযুক্ত যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি কোনো বইকে ‘মানসম্পন্ন’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন তাদের নিজেদের রচিত সাহিত্য মান কেমন? সাহিত্যিক হিসেবে এ পর্যন্ত তারা কী সাহিত্য রচনা করেছেন যে বাংলা একাডেমির মত একটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মান নির্ধারণের দায়িত্ব তাদের ওপর পড়ে? তারা কি তেমন নির্মোহ সাহিত্য সমালোচকদের কেউ যে হাজার হাজার বই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পাঠান্তে ‘মানসম্পন্ন’ বইয়ের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন?

সদ্য সমাপ্ত বইমেলা বিস্তৃত পরিসরে হয়েছিল। বই বিক্রি হয়েছে অনুমিতভাবেই বেশি। টাকার হিসাবে এটা গতবারের চাইতে ৫ কোটি টাকার বেশি। ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিলো। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বইপ্রকাশ ও বইবিক্রির এই সংখ্যা অনুমিতভাবেই বেশি।

বই প্রকাশ ও বই বিক্রি বেশি হলেও লেখকগণ কি প্রাপ্য সম্মানী পেয়েছেন? উত্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘না’ বলে ধারণা করি। ফলে বই বিক্রির টাকাগুলো প্রকাশকদের পকেটেই গেছে। লেখকগণ এক্ষেত্রে বরাবরের মতো বঞ্চিত হয়েছেন।

এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শাকুর মজিদের এক ফেসবুক স্ট্যাটাস; যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘এবার বইমেলায় নাকি ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যদি বাংলা একাডেমির এই তথ্য সঠিক হয়, তবে ১৫% হারে লেখকের সম্মানী সাড়ে ১০ কোটি টাকা হওয়ার কথা। বই মেলা শেষে প্রকাশকেরা ক্যাশ-বাকশো গুছিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।’ শাকুর মজিদের মতো প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত লেখক যদি লেখকের সম্মানী প্রাপ্তির বিষয়ে সন্দিহান থাকেন তাহলে অন্যান্য লেখকদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

শাকুর মজিদ তার বই প্রকাশ ও বিক্রি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতায় জানাচ্ছেন, “বছর চারেক আগে এক প্রকাশক আমার কাছ থেকে একটা বই নিয়েছিলেন। আমাকে ৫ কপি লেখক কপিও দিয়েছিলেন। আমি আরও ১০-২০ কপি তার কাছ থেকে কিনেও নিয়েছিলাম। … আজ এক প্রয়োজনে একজন আমার সব বই কিনতে চাইলেন। সেই প্রকাশকের স্টলে গেলাম। প্রকাশক হাসতে হাসতে বললেন, আপনার বইটা গত মেলায়ই শেষ হয়ে গেছে। এই মেলা শেষে এটা আমার সেকেন্ড এডিশন করব। আমি কিন্তু এখনো জানি না, বইটা তিনি কত কপি ছেপেছিলেন আর এজন্য আমার কোন সম্মানী পাওনা আছে কী না।”

লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকের এই লুকোচুরি সত্যিকার অর্থে আমাদের পুরো প্রকাশনা শিল্পের একটা স্মারক। এখানে লেখক অনেকক্ষেত্রেই জানেন না কত বই প্রকাশ হয় তার, বিক্রিও কত হয়; আর বিক্রয়লব্ধ অর্থপ্রাপ্তি তো বহু দূরের পথ!

এরবাইরে আছে লেখকদের কাছ থেকে বই প্রকাশের টাকা নেওয়া। বই প্রকাশের খরচ হিসেবে অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের কাছ থেকে টাকা আগেভাগে নিয়ে নেন তাদের লাভের অংশ সহ। প্রকাশের আগেই প্রকাশনা খরচ ওঠে আসে তাদের। লেখককে কিছু বই দিয়ে দেওয়ার পর বাদবাকি বইগুলো তারা মেলায় বিক্রি করেন, কিন্তু প্রাপ্ত ওই টাকার অংশ দেন না তারা লেখকদের। লেখকেরাও অনেকক্ষেত্রে চাওয়ার সাহস পান না। অথচ মেলা চলাকালীন লেখকগণ স্টলে বসে সেসব বই বিক্রি করতে সাহায্য করে থাকেন।

লেখক সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে বাংলা একাডেমি। ভাবতে পারে বইপ্রকাশে লেখকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টিও। কেউ টাকা দিয়ে বইপ্রকাশ করলেও বিক্রয়লব্ধ অর্থের একটা অংশ যেন লেখকেরাও পান সেটা নিয়ে করণীয় কিছু আছে কীনা এনিয়ে তাদের ভাবা উচিত। প্রকাশকদের দেওয়া তথ্যমতে বাংলা একাডেমি জানাচ্ছে এবারের বই বিক্রি ৭০ কোটি টাকারও বেশি। এই অর্থ পাঠক-ক্রেতাদের কাছ থেকে। এরবাইরে লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকদের লেনদেনের বিষয়টিও সামনে আনা উচিত। এ হিসাব পাওয়া গেলে বইমেলায় অর্থ লেনদেনের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি।

বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত হওয়া মানে আমাদের মূলে আঘাত লাগা। তবু গত কয়েক বছর থেকে সেরকমই হয়ে আসছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার সহ অনেকগুলো বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা একাডেমি সমালোচনার মুখে। সমালোচনাকারীদের কেউ বাংলা একাডেমির সভাপতি কিংবা মহাপরিচালক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন এমনও না। এই সমালোচনা মূলত একাডেমির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের। হতাশার বিষয় হচ্ছে তবু বিতর্কিত হচ্ছে তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। হাজার হাজার প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে কিছু বইকে ‘মানসম্পন্ন’ বই হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাংলা একাডেমি নতুন করে সে সমালোচনার রসদ যোগাল, অথচ অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত এমন কাজে হাত না দেওয়ার সুযোগটা তাদের ছিল।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View