লোকটি যখন কথা বলে, আশেপাশের লোকজন একবার হলেও ফিরে তাকায় কে কথা বলছে শোনার জন্য। পথে হলে পথচারী, কোন রেস্টুরেন্টে হলে আশেপাশের টেবিলের মানুষ। বাসে ট্রেনে হলে সহযাত্রী। কিংবা কোন অনুষ্ঠান হলে আমন্ত্রিত অন্য অতিথিরা তার কন্ঠের কারণে ফিরে তাকান। উনি আবার বেশ জনপ্রিয়ও বটে। কারণ বেশ পয়সা খরচ করেন এখানে ওখানে।
উনি শিল্প সংস্কৃতি করে বেড়ান, মনমুগ্ধকর ব্যবহার। বেশ দান দিয়ে নিজের শিল্পী সত্তার উন্মেষ ঘটাচ্ছেন। এই দেশ আসার পরপর উনি ভেক ধরেছেন দেশপ্রেমিকের, জুটে গেছে উনার পিছনে সুখের পায়রারা। ধরি উনার নাম কেরামতি উল্লাহ।
কেরামতি উল্লাহর খুব দেশপ্রেম, উনার আবার দলীয় পরিচয় আছে বেশ শক্ত, তার দলীয় সরকার দেশ পরিচালনা করলেও উনি দেশান্তরী। তিনি বসত গেড়েছেন এদেশে এবং নিয়ে এসেছেন বাচ্চাকাচ্চা, একাধিক বউ ও সাথে অনেক অনেক অনেক টাকা। রাষ্ট্রের একটি ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা লোন নিয়েছেন। এই টাকাগুলি এদেশে বিভিন্ন পথে নিয়ে আসছেন। বাচ্চাকাচ্চা ও বউদের নিয়ে তিনি বেশ গুছিয়ে বসেছেন।
দেশপ্রেমিক লোকটি দুইহাতে টাকা খরচ করছেন। বাড়ি দেখে চলেছেন, বড়সড় তিন লেভেলের বাড়ি। দেখে চলেছেন নানান মডেলের গাড়ি। আহা দেশে যে আরাম আয়েশে থাকতেন এখানেও তাই তো থাকতে হবে। না হলে প্রেস্টিজ তো থাকবে না। ব্যান্ডের দোকান ছাড়া অন্য কোন দোকানের কাপড়ও কেনেন না। ব্র্যান্ডহীন অন্য কোন দোকানে গেলে উনার মত দেশপ্রেমী সাংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তির ইজ্জত তো নাই হয়ে যাবে।
আহা ব্র্যান্ডের কাপড়, জুতো এক্সসারিজ তো মন চাইলে যে কেউ পরতে পারে, নিজের উপার্জনের কষ্টের টাকা মানুষ যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে খরচ করবে। কেরামতি উল্লাহ তার কষ্ট করে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া টাকা যেঝানে ইচ্ছে খরচ করুন তাতে কার কী?
এদেশে পাকাপাকি থিতু হচ্ছেন। লোনের টাকায় না হয় পনের বিশ বছর আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া যাবে চৌদ্দগুষ্টি মিলে। কিন্তু এ দেশে কমিউনিটির মানুষজনের কাছে ইজ্জত সমুন্নত রাখতে হবে। তাই চলছে ঘন ঘন বিজনেস মিটিং।
চলছে দেশের কালচারকে তুলে ধরার পরিকল্পনা। আহা উনি দেশ বড়ই মিস করেন। তাই সব সময় দেশ নিয়ে ভাবেন, কাজের মাঝে দেশকে তুলে ধরেন। তিনি দেশের নিয়মনীতি বেশ মান্য করেন। উনার কথায় কাজে দেশ প্রেম ঝরে ঝরে পরে। আহা কি কোমল হৃদয় উনার। বিদেশে থাকবেন দেশকে মিস করবেন তাই এত্তো এত্তো দেশি টাকা এনেছেন ডলার করে। এত্তো এত্তো টাকা এনেও এদেশে উনি অবশ্য পুরো পরিবার নিয়ে লো ইনকাম ক্যাটাগরিতে আছেন।
খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা সব ফ্রি নিচ্ছেন। প্রায় বছর ধরে এদেশে আছেন। আরামে আয়েশে আছেন। ঠাট-বাট বজায় রেখে আলিশান অবস্থায় আছেন। ব্যাংক লোনের টাকা ও এদেশের লো ইনকাম গ্রুপের মত ফ্রি সব সুবিধা নিচ্ছেন। এই দেশে প্রচুর ফ্রি খাওয়া বড়লোক আছে। এরা গাছের খায়, তলারও কুঁড়ায়। এদের মত মানুষের জন্য আস্তে আস্তে অনেক সুবিধা বাদ হয়ে যাচ্ছে।
এদের আরেকটা নাম পরিচয় আছে, এরা ব্যাংক লুটেরা, এরা ব্যাংক ডাকাত এরা ব্যাংক চোর, এরা দেশদ্রোহী। এদেশে যারা এক ডলার ইনকাম করেন বৈধভাবে সেও ইনকাম ট্যাক্স দেয়। এই দেশে প্রায় ৩৮ পারসেন্ট ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়। লো ইনকামদের খাওয়াপরা, চিকিৎসা জোটে এদেশের মানুষের দেয়া ট্যাক্সে।
ব্যাংক লোন, ইস কি মজার ব্যাংক লোন। শত শত কোটি টাকা নিলেও ফেরত দিতে হয় না একটাকাও। আহা রে কি দারুন ব্যাপার। বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের দুটি বাজেটের প্রায় সমান। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজন মিলে একটি চক্র ব্যাংক গিলে খাচ্ছে। সাধারণ মানুষের আমানত খেয়ানত করছে। অথচ সরকার নির্বিকার। তারা দেখেও না দেখার ভান করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম করেছে বাংলাদেশিরা। ধানমণ্ডিতে কিছুদিন আগে একশ’ কোটি টাকার জমি মাত্র ৩৫ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। বাকি ৬৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও সরকার নির্বিকার।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, সোমবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে একশ’ জন ঋণ খেলাপির নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে তারা আসলে কিছুই না। আসল ঋণ খেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমাদের দেশের ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। এই যে প্রত্যেক দিন এসব তথ্য পত্রিকায় উঠছে, এসব বিষয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বিবৃতি আমাদের কাছে আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তখন মানুষ ধরেই নেয় ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট হচ্ছে। হলমার্ক কাণ্ড আমরা দেখেছি। প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
অর্থমন্ত্রী তো ব্যাংকের টাকা ঋণ হিসেবে দেন না। দেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকা ব্যক্তিরা। সরকারি ব্যাংকের বোর্ডে সাধারণত থাকেন রাজনীতিবিদেরা। আমাদের দুর্বলতা এখানেই। যেসব রাজনীতিবিদরা বোর্ডে থাকেন ব্যাংকিং সেক্টরের তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারা কেবল বোঝেন, কত পার্সেন্ট দিলে ঋণ অনুমোদন করবেন। এটাই তাদের একমাত্র কাজ।’
যত দিন যাচ্ছে, ততই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা টাকার পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে লুট হয়ে যাওয়া টাকাও রয়েছে। এদিকে সরকারের চলমান বড় বড় প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে যে ঘুষ আদান-প্রদান হয়েছে, সেই ঘুষের টাকাও সুইস ব্যাংকে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. ইব্রাহিম খালেদ। তার মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা টাকা বিনিয়োগ করছেন, সেই টাকাও সুইস ব্যাংকে তারা জমা রাখছেন। কিন্তু তা উদ্বেগের বিষয় নয়।
বিনিয়োগের নামে বিদেশে নেওয়া টাকা ও মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত টাকাও সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। বিদেশে লোক পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদেশে বসে যে টাকা নেওয়া হয়েছে, ওই টাকাও এসব ব্যাংকে রাখা হয়েছে বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। একইসঙ্গে পণ্য আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং অ্যান্ড ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইব্রাহিম খালেদ ও ইফতেখারুজ্জামান।
বিএনপি সরকার যখন দেশ চালিয়েছে তখন ঘটেছে অর্থ লুটপাটের ঘটনা। সেই দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ কথা বলেন ৭৪ সালের মতো দেশের ব্যাংকগুলোর অর্থ লুটপাট চলছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর আগে শেয়ার বাজার, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা, রূপালী ব্যাংক কেলেঙ্কারিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ওইসব জালিয়াতিতে জড়ি সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও নেতৃবৃন্দসহ রাঘব বোয়ালদের বিচার করা হয়নি। তাই তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকা লুট করেছে। এতে সমস্ত ব্যাংক আজ ফোকলা হয়ে পড়েছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে অন্তত ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন, যারা ঋণ নিয়েও পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতের শতাধিক ঋণগ্রহীতার হদিস মিলছে না। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এসব ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। একদিকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে তাদের মর্টগেজ সংক্রান্ত কাগজপত্রও ভুয়া। এই প্রতারক ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে জানা গেছে। এর সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাংকের টাকা। শুধু তাই নয়,নতুন ব্যাংকগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিক।
এই প্রতারকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকের টাকা লুটকারীদের কী বলবেন, ব্যাংক লুটেরা? ব্যাংক ডাকাত? নাকি ব্যাংক চোর? নাকি দেশদ্রোহী বা দেশ বিরোধী? সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মত বলি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই দেশের ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। যা এ খাতকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের ভিতরে সুশাসন না থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবে দেখভাল না করা ও অর্থ বিভাগের তদারকির ঘাটতি রয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এগুলোর বাইরে সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
রাজনৈতিক সিগন্যাল না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও প্রয়োগ করা যায় না। আমাদের রাজনৈতিকরা কি কখনো দেশকে ভালবাসবেন? দেশকে পঙ্গু না করে সত্যি সত্যি দেশকে উন্নয়নের পথে নেবেন। কেরামতি উল্লাহ্রা দেশের ব্যাংকগুলি ফাকা করে নিজেদের ফুলে ফেঁপে ওঠা বন্ধ করবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে, আমরা যারা খুব সামান্য হলেও দেশের উন্নয়নে রেভিনিউ দিয়ে সহায়তা করি, তারা এই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক পরিচালক ও কেরামতি উল্লাহদের শুভবুদ্ধির অতিসত্বর জাগ্রন প্রত্যাশা করে যাব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)