পৃথিবীর নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা কিভাবে বিভিন্ন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সম্পদকে গোপন করে রাখছেন তার এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্রাইম অব দ্য সেঞ্চুরি’।
কিন্তু লাখ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা প্রতিষ্ঠান আসলে কী। তাদের কাজই বা কী? তাদের কাজের পরিসর, তারা কাদেরকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে, গ্রাহকদের কিভাবে তারা বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকেন, নথি ফাঁস হওয়ার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কী? প্রতিষ্ঠানের আদ্যোপান্ত নিয়ে করা বার্তা সংস্থা অ্যাসেসিয়েট প্রেস-এপির প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো-
মোসাক ফনসেকা নামের প্রতিষ্ঠানটি পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। যারা গোপনীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলোকেই বলা হচ্ছে পানামা পেপারস। ১৯৭৭ সালে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক আইনের উপর ভর করে এটি প্রতিষ্ঠা করেন পানামার দুই নাগরিক জার্গেন মোসাক ও র্যামন ফনসেকা।
মোসাক ফনসেকা কী
পানামাভিত্তিক বিশ্বখ্যাত গোপনীয়তা রক্ষাকারী আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা। মক্কেলদের পরামর্শের বিনিময়ে তারা বার্ষিক ফি নিয়ে থাকে।
মোসাক ফনসেকা কোথায় কোথায় কাজ করে
বিশ্বের ৪২টির বেশি দেশে প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে। এসব শাখায় কর্মরত আছেন ৬০০ কর্মী। ব্যবহারকারী পানামার বাইরেরও হতে পারে। এতে ব্যক্তিগত হিসাব ছাড়াও যেকোনো কােম্পানির নামে হিসাব খোলা যায়।
ফাঁস হওয়া নথির পরিমাণ
সম্প্রতি মোসাক ফনসেকা’র এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে। বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কিভাবে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন? তবে ফাঁস হওয়া নথির আসল পরিমাণ কতো? সেটা এখনো অজানা। তবে ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা নথির চেয়েও এর পরিমাণ বেশি বলে বলা হচ্ছে।
এছাড়া ২০১৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মমতা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির চেয়েও বেশি।
কী রয়েছে ফাঁস হওয়া নথিতে
ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কিভাবে গোপনীয়তার আড়ালে ল’ ফার্মটি বিশ্বনেতাদের অর্থপাচার, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো এবং কর ফাঁকিতে সহযোগিতা করেছে। এতে আরও উঠে এসেছে, স্বৈরশাসকসহ বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৭২ জন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিজেদের দেশ থেকে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্র। তবে ফনসেকা বলছে, কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা গত ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছে।
কিভাবে ফাঁস হলো ওইসব নথি
নথি প্রথমে জার্মান দৈনিক সুদেস্ক জেইটাংয়ের হাতে আসে। পরে এগুলো সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের (আইসিআইজে) কাছে পাঠায় পত্রিকাটি।
বিবিসি ও গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসসহ বিশ্বের ১০৭টি মিডিয়ার হাউজের ৩২৫ জন সাংবাদিক এবং ৭৮টি দেশ এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে’র ডিরেক্টর জেরার্ড রাইল বলেন, নথিগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির গত ৪০ বছরের প্রাত্যাহিক কার্যক্রমের তথ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যদি এগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হয়, তবে তা পুরো দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেবে।
কী ধরনের সহায়তা দেয় মোসাক ফনসেকা
গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ব্যবসায়িক সহযোগীদের নিজেদের ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের সুযোগ দেয় মোসাক ফনসেকা। এ প্রতিষ্ঠানটি সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসসহ বিভিন্ন স্থানে ট্যাক্স হ্যাভেন পরিচালনা করে। নিজ দেশের বাইরে অর্থ রাখার বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে তার মধ্যে মোসাক ফনসেকার অবস্থান চতুর্থ। তিন লক্ষাধিক কোম্পানির সঙ্গে তারা কাজ করে। যুক্তরাজ্যে তাদের বেশ মজবুত অবস্থান রয়েছে।
কী বলছে মোসাক ফনসেকা
এই ডাটা ফাঁসের বিষয়ে বিশদ আলোচনায় যেতে আগ্রহী নয় মোসাক ফনসেকা। গ্রাহকের গোপনীয়তার রক্ষার দিকেই অধিক নজর তাদের। মোসাক ফনসেকা বলছে, তারা মানি লন্ডারিং বিরোধী আইন মেনে চলেছেন। সেদিকে খেয়াল রেখেই তারা মক্কেলদের সেবা দিয়েছেন। নিজেদের সেবার যে কোনো ধরনের অপব্যবহার রোধে তারা সচেষ্ট ছিলেন।
সবচেয়ে বেশি অ্যাকাউন্ট যেখানে
ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বারমুডাসহ আরো প্রায় একজন ডজন দেশ যেখানে এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
অবৈধ ব্যবহারকারীর সংখ্যা
২শ দেশ ও টেরিটরির বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, খেলোয়াড়, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকসহ সব মিলিয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার লোকের নাম রয়েছে। এদের ১৪০ জনের বেশি রাজনীতিবিদ। এরমধ্যে রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ।
অতীত কেলেঙ্কারী
ব্যাংকিং সেক্টরে গোপন নথি ফাঁস করে ২০১৪ সালে প্রথম বড় আকারে নজরে আসে মোসাক ফনসেকা। তখন ইউরােপে ছােট দেশ লুক্সেমবার্গের বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কােম্পানি ও কয়েকজন কোটিপতির ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে। এছাড়া ১৯৮০ দশকে একজন পাকিস্তানি বিনিয়োগকারীর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংকের অর্থ পাচারের তথ্য এই মোসাক ফনসেকা থেকে প্রকাশিত হয়।
মোসাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
মোসাক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানের ব্রাজিল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠে। যার তদন্ত এখনো চলছে। তবে এই অভিযােগ অস্বীকার করেছে মোসাক ফনসেকা।