
সুরসৈনিক শহীদ আলতাফ মাহমুদ, সংগীত ও মঞ্চ ব্যক্তিত্ব শিমুল ইউসুফ, নৃত্য শিল্পী মিনু হকের সঙ্গে সংগীত শিল্পী সারাহ বিল্লাহ’র সম্পর্কটা পারিবারিক। এমন সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা এই সংগীতশিল্পী এখন কানাডা প্রবাসী। তবে সেই সুদূর পরবাসেও তিনি গাইছেন বাংলার গান,বাংলায় গান। কিন্তু প্রবাসে দেশের সুর-গান পৌঁছে দেয়া মানুষটি নিজের দেশেই অহরহ অপসংস্কৃতির প্রকোপে হতাশ। বিশেষ করে দেশের গণমাধ্যমে দেদারসে হিন্দি গান বাজানোর প্রবণতায় বিস্মিত দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক পরিবারের এই প্রবাসীজন।
শেকড়ের টানে দেশে আসা কণ্ঠ ও শব্দশৈলীর সারাহ বিল্লাহ চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডায় তুলে ধরেন দেশের সংগীত শিল্প নিয়ে নিজের ভাবনা, আশা-হতাশার কথা।
তার সংগীত জীবন আর প্রজন্মের সংগীত চর্চার নানাদিক উঠে এলো আলাপনে।
সুর সাগরে সারাহ:
পরিবারের আপন আঙিনায় সুর-সাগরের ছন্দময়তায় মুগ্ধ সারাহ বিল্লাহ শৈশব থেকেই সংগীতকে লালন করেছেন হৃদয়ে।

বুঝে নিয়েছিলেন মনের খোরাক যোগাতে গানের জুড়ি নেই। ছোটবেলায় গানের গুরু হিসেবে পান ওস্তাদ আলী ইমাম চৌধুরীকে। সংগীতের অ-আ,ক-খ শিখে কণ্ঠের তালিম নিয়ে সুরের সাগরে পাড়ি জমানো সেই থেকে শুরু। ধ্রুপদী সংগীত শেখা চললেও কোথায় যেনো মাটির টান অনুভব করতেন তিনি সবসময়। পলি মাটির গন্ধমাখা পল্লীসুরের লোকসংগীতে গলা ছেড়ে গাইতেন আপন মনে।
সংগীত সাধনাকে কোনো গণ্ডিতে আটকে রাখেননি সারাহ। ১৯৯৮ সালের দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নজরুল-রবির সুরে পাকাপোক্ত দখল নিতে ভর্তি হলেন ছায়ানটে। এর মধ্যেই আবার ক্যাম্পাসে ‘হেভিমেটাল-ভক্ত’ বন্ধুদের সঙ্গে গান-বাজনার আড্ডাটা তাকে প্রভাবিত করেছিলো বেশ। গান-গুঞ্জন,কোরাসের আড্ডা ছাঁপিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ব্যান্ড ‘ক্রিমসন’।
মেটাল ভক্ত বন্ধুদের সঙ্গে ড্রামস,বেইজ,লিডের ঝঙ্কারে ক্রিমসন ভোকাল সারাহ’র গলায় স্পষ্ট ছিলো লালন-হাসন-শাহ আবদুল করিমের রেশ। সব মিলিয়ে দারুন এক ‘ফিউশন-আমেজ’।
ক্রিমসনের একটি অ্যালবাম বের হয় ২০০৬ সালে ইমপ্রেস অডিওভিশন থেকে। উঠতি ব্যান্ড হিসেবে সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে নবাগত ব্যান্ডের নমিনেশন পায় ক্রিমসন।
২০০৮ সালে তার মিক্সড অ্যালবাম ‘মেঘে মেঘে’ এবং ২০১০ সালে মিফতাহ্ জামানের সঙ্গে ডুয়েট অ্যালবাম ‘শুধু তোমাকে’ প্রকাশিত হয়।
বন্ধুদের লেখা ও নিজের সুরে তার একক অ্যালবাম ‘মোমের আলো’ প্রকাশিত হয় বেঙ্গল মিউজিক থেকে। সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে বেস্ট লিরিক পুরষ্কার অর্জন করে তার অ্যালবামের একটি গান।
২০১০ সালে পাড়ি জমান পরবাসে। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, কথাটি সত্য প্রমাণ করে কানাডার টরোন্টোতেও সারাহ’র সংগীত চর্চা থেমে থাকেনি। উৎসব-পার্বণে প্রবাসী বাঙালিদের নানা আয়োজনে তিনি গান রবি-নজরুলের গান, আর পল্লীগীতির অনুরোধ রাখেন সানন্দে।
গানের পাশাপাশি সারাহ্ কানাডায় শব্দ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা নিয়ে বর্তমানে একজন অডিও-ভিজ্যুয়াল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। দেশকে মিস করছেন ভাবলেই চলে আসেন সবুজের আঙিনা প্রিয় স্বদেশে।
স্বদেশী সংগীত ভাবনা:
প্রবাসে থাকলেও সারাহ বিল্লাহ’র মন পড়ে থাকে স্বদেশে। দেশে এসে স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর সময়ও সংগীত নিয়ে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে না। চ্যানেল আইয়ের ছাদে আড্ডার ফাঁকে দেশের সংগীতাঙ্গনে হাল আমলের ব্যাধি নিয়ে হতাশা জানিয়ে সারাহ বললেন,‘মায়ের সঙ্গে বসে টিভি দেখছিলাম। উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি অনুষ্ঠান চলছিলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম পুরোটা সময় ধরে শিল্পীরা শুধু তাঁর জনপ্রিয় হিন্দি গানগুলোই গেয়ে গেলেন, অথচ তাঁর অনেক জনপ্রিয় বাংলা গানও ছিলো কিন্তু’।
সংগীতাঙ্গনে শ্রোতা-শিল্পীদের মধ্যে একটি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে সারাহ বিল্লাহ বলেন,‘আরও অবাক হই যখন সবার কাছে সহজে সংগীত পৌঁছে দেয়া এফএম রেডিওগুলোতেও দেদারসে হিন্দি গান বাজে। আমি হিন্দি গানের বিরোধীতা করছি না। বিশ্বসংগীতের অংশ হিসেবে যেকোনো ভাষার গান বাজানোই যায়, তাই বলে সারাদিন!
এফএম রেডিওগুলোর দাবি এসব নাকি বিজ্ঞাপনদাতারা চায়, অথচ তাদের দায়িত্ব বাংলা গানকে তুলে ধরা, বাংলার শিল্পীদের পাশে থাকা’।
আশা-নিরাশার দোলাচালে:
‘বহু চড়াই-উতড়াই পেরিয়েছে বাংলা গান। লালন, রবি, নজরুলের বাংলায় ষাটের দশকে তরুণরা দেশীয় ঘরানায় শুরু করেছিলেন পপ-রক। দীর্ঘ পথ চলার পর এখন দেশের অডিও শিল্প একটি ভালো অবস্থানে থাকার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্য যে আজও গান গাওয়া কেবলই একটি নেশা হয়েই আছে। এখানে গান গেয়ে বেঁচে থাকার খোরাক যোগানো কঠিন। সংগীত শিল্পীকে আগে রুটি-রুজির সংগ্রামে নামতে হয়।
এরপরও বহু কষ্টের,সাধনার গানগুলো যখন পাইরেটেড হয়ে ’ফ্রি এমপিথ্রি’ হয়ে যায় তখন হতাশার চূড়ান্তে পৌঁছায় শিল্পীর মন’। দেশের অডিও শিল্প ও শিল্পীদের সংগীত-সংগ্রাম নিয়ে এভাবেই নিজের মনের কথাগুলো বলেন সারাহ।
তবে এ প্রজন্মের তরুণদের ওপর ভরসা হারাতে চান না তিনি। নিজের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে চর্চা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে সারাহ বলেন,‘দেশে গানের মানুষ আছে অনেক। তবে একটি জিনিসের বড় অভাব। দেশের বাইরে সংগীতের সঙ্গে শুধু শিল্পী নন বরং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা দেখেছি। আর এখানে শিল্পীকে একাই লড়ে যেতে হয়। এখনো সত্যিকার অর্থে দেশে কপিরাইট আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। রয়্যালটি বা লভ্যাংশের বিষয়টি সব সময়ই উপেক্ষিত এখানে। অথচ দেশের বাইরে কেউ জনপরিসরে রয়্যালটি ছাড়া গান বাজাবে এটা ভাবাই যায় না। সেজন্য সেখানে শিল্পী ও গান বেঁচে থাকে’।
নতুন দিনের সুযোগ কাজে লাগাতে নবীনদের সামনে এখন অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে জানিয়ে শব্দশৈলীর সারাহ বলেন, ‘এখন সামাজিক মাধ্যমের যুগ। সাউন্ড ক্লাউড, ইউটিউব, ফেসবুকসহ নানা প্যাল্টফর্মে এখন নিজের মনের ভাবনা-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা অনেক সহজ। নিজেকে উপস্থাপনের এমন সুযোগ লুফে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, বাংলা গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্ব আঙিনায়’।