শুক্রবার সকালের দিকটা রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকাই থাকে। তার মধ্যে রমজান মাস। আজ ছিলো অস্বাভাবিক রকমের ফাঁকা। বাসা থেকে বের হয়ে আমিও গতি হারিয়ে ফেললাম। ধীর পায়ে বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়াই। অনেকক্ষণ পরপর একটি করে বাস আসছে। ঠিক যেন চিনতেই পারছিলাম না আমার চিরচেনা এই শহরটাকে। যাত্রী ছাউনিতে বসে পড়লাম, যা আমি সচরাচর করি না। ঠিক আমার পাশেই সদ্য দাঁড়ি-গোঁফ গজানো এক ছেলে বসে আছে। দুটি ব্যাগ নিয়ে। একটু দূরে এমন আরো ২/১ জন। এর মধ্যে আমার পাশের ওই ছেলেটির ফোন বেজে উঠলো। খুব আন্তরিক গলায় রিসিভ করলো সে। কথা শুনে যতটুকু বুঝলাম সে ঢাকায় লেখাপড়ার কারণে থাকে। তার পরিবারের সবাই থাকেন ভিন্ন কোন জেলায়। ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছে ছেলেটি। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে হয়তো বারবার খোঁজ নিচ্ছে ছেলে কখন বাড়ি ফিরবে?
এর মধ্যে বাস এলো একটি। আমরা দুজনে উঠে পড়লাম বাসটিতে। কিছুটা ইচ্ছে করেই ছেলেটির পাশের গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য কিছুটা খাতির জমিয়ে তার মনের অবস্থা জানা। কিন্তু তা আর হলো না। আবারো ফোন বেজে উঠলো ছেলেটির। বুঝলাম এবারের ফোনটি তার মায়ের। এপাশ থেকে বলে উঠলো এই মাত্রই তো বাবার সাথে কথা হলো। বুঝলাম আগের ফোনটি ছিলো বাবার। এর চেয়ে বেশি কিছু জানার সুযোগ হলো না আমার। গন্তব্যে পৌঁছে নামতে হলো আমাকে।
এবার আমার রিকশা যাত্রা। কিন্তু কোনোভাবেই মাথা থেকে ওই পাঁচ সাত মিনিটের সহযাত্রীকে ফেলতে পারছিলাম না। নানা প্রশ্ন আসতে লাগলো মনে। আমি যেন স্পষ্টই দেখতে পারছিলাম ছেলেটির বাড়ির চিত্র। হয়তো মধ্যবিত্ত বাবার এই মুহূর্তে হাতে খুব বেশি টাকা নেই। ছেলেটির বাহ্যিক রূপ দেখে আমার এমনই মনে হয়েছে। আর তাছাড়া আজ মাসের প্রথম দিন এমনটা হওয়ায় স্বাভাবিক। তারপরেও তিনি হয়তো বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে ফেলবেন আজকে। ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করে ঈদ করতে বাড়ি আসছে, ব্যাপারটাই আলাদা। মায়ের হয়তো নানা ব্যস্ততা। ছেলের ঘরটি ঠিকঠাক করে রাখা। পছন্দের আচার বের করে রোদে দেয়া। ছেলের পছন্দের খাবার সারাদিন ধরে তৈরি করা। আর এর ওর সাথে ছেলের ছোটবেলার নানান কিচ্ছা করা। হয়তো ছোটবেলার যে বন্ধুদের সাথে ঢাকায় পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো, যাদের এর মধ্যে এই সুযোগ হয়নি, তারা হয়তো এরই মধ্যে দু একবার ঘুরে গেছে বাসা থেকে। বন্ধু কখন আসবে? অনেক গল্প বাকি আছে শোনার। যদি বা বান্ধবী থেকে থাকে তার তো আজই ঈদ। কতোদিন পর দেখা হবে। লোকলজ্জা না করেই হয়তো কোন না কোন অজুহাতে যাবে আজ ছেলেটির বাসায়। অন্য কিছু নয় শুধু আর চোখে দু একবার দেখা। এটাই বা কম কিসে।
পাড়ায় ক্রিকেট কোচ নিশ্চয় কাল থেকেই অধির আগ্রহে আছেন ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য।আফটারঅল ঢাকায় থাকে বলে কথা। কতো মানুষের সাথে মেশে কতো জানাশোনা। বিসিবি সামনে কি করছে? মাশরাফি শাকিব সত্যিই কি রাজনীতিতে নামছে? এমন কতো কতো প্রশ্ন থাকবে হয়তো। হয়তো অহেতুক মায়ার জালে আটকে থাকা কোন চায়ের দোকানদার, বাইসাইকেল সারানোর মিস্ত্রি, স্টর রুমে পড়ে থাকা হাওয়াবিহীন ফুটবল, পাশবালিশ, হুমায়ূন আহমেদ এর কিছু উপন্যাস, এমন অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে তার জন্য। বাড়ি ফিরছে আমাদের খোকা।
পাশ দিয়ে বিকট শব্দে একটি বাস চলে গেলো। আমি চমকে উঠে বাস্তবতায় ফিরলাম। মনে হলো কি ভাবছি এসব অচেনা একজনকে নিয়ে। পরক্ষণেই চিন্তা এলো। এই বাসটি পাগলের মতো ছুটছে কেন? এই পথেই তো কতো শত স্বপ্ন নিয়ে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে আমাদের ভাই, সন্তান, বাবা, বন্ধুরা। একটু ভুলেই তো ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে একটা আস্ত পরিবার। ড্রাইভাররা কেন আরো একটু সতর্ক হবেন না? তাদেরও তো পরিবার আছে। তারাও তো এই পথেই চলে। আর একটা কথা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। মাদকের কারণে যদি এনকাউন্টার হতে পারে তো ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য দায়ীর এনকাউন্টার নয় কেন? জানি এসব কিছুই হবে না। শুধু প্রতিদিন আমরা স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুবো। জানি না ক’জন এর মধ্যে ফিরতে পারবো। তবে এটুকু জানি কেউ না কেউ আমাদের জন্য দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ এই ঈদে আমরা সবাই যেন নিজ নিজ গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছতে পারি। ভালো হোক সবার। সুবুদ্ধির উদয় হোক পরিবহনখাতে সংশ্লিষ্ট সকলের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)