
দৌরাত্ম্য, সিন্ডিকেট, আত্মীয়করণ, আঞ্চলিকীকরণ প্রত্যয়গুলো রাজনৈতিক ময়দানে নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রত্যয়গুলোর ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক শতাংশের হারও জনমানুষ তথা রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে কখনোই স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত হয় না। বরঞ্চ নেতিবাচক এবং দল তথা সংগঠনের জন্য ও ক্ষতিকর হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার যেসব প্রভাবশালী নেতা কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দল ও সংগঠনে এ সকল প্রত্যয়গুলোর চর্চা ও বাস্তবায়ন করে থাকে তারা কখনো দল কিংবা সংগঠনের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে না। হয়তো সাময়িকভাবে সুবিধা পায় তারা কিন্তু সংগঠনটির স্বাভাবিক কাঠামোকে স্থবির করে দেয়। কাজেই যেকোন দলের জন্য সংগঠনকে তৎপর ও কল্যাণকর রাখবার জন্য এসব প্রত্যয়ের বর্জন অবশ্যাম্ভাবী। সেই বিবেচনায় আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে কাঙ্খিত নেতৃত্বের অপেক্ষায় তৃণমূলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ও সমর্থকরা।
আসন্ন ১১-১২ মে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলন ঘিরে শুধু ছাত্রলীগ নয় আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠন ও সিনিয়র নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ ও আবেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কে আসবে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দায়িত্বে। তাছাড়া নির্বাচনী বছরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনার কাজেও ছাত্রলীগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থাকায় নীতি-নির্ধারণী মহলে বেশ সোচ্চার কমিটি প্রদানের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গুরুত্বের সাথে বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের যথাযথ ভূমিকা গ্রহণের উপরেও গুরুত্বারোপ করেছেন।
সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। কমিটি নিবিড়ভাবে তাদের কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছে। ইত্যবসরে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এসেছেন এবং তিনিও কমিটির বিষয়ে নজরদারি ও দায়িত্বশীল নেতাদের মতামত গ্রহণ করবেন এবং গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃকও পদ প্রত্যাশী প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়।
এদিকে গত বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব কেমন হবে প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমঝোতায় সফল না হলে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোট হবে। তবে ভোটের মাধ্যমে হওয়ারও একটা ঝামেলা আছে। তারা ইয়াং ছেলেপুলে, ভোটের মধ্যে অনেক কিছুই হতে পারে। তারা প্রভাবিত হতে পারে। তবে আমরা দেখবো যদি ভোটের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব এসেছে কিনা। না এলে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনারা জানেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে একটা উপযুক্ত বয়সসীমা রয়েছে, তাদের ছাত্র হতে হবে। এদের মধ্য থেকেই নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া হবে।’

এদিকে সম্মেলনকে ঘিরে পদ প্রত্যাশীরা দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বাসায় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা করছেন। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, পদ প্রত্যাশীরা সকলেই সিন্ডিকেটমুক্ত কমিটির প্রত্যাশা করছেন। সকলেই আশা প্রকাশ করছেন পূর্ব অভিজ্ঞতা, পারিবারিক পরিচয়, দলের দুঃসময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা যোগ্য কর্মীর হাতেই যেন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার অর্পন করেন। দলছুট, ভিন্ন দল থেকে আসা, পারিবারিকভাবে অন্য দলের ঐতিহ্য লালন করা, সুবিধাভোগী ও হুট করে নেতা হওয়ার খায়েশ সম্পন্ন কাউকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসা ঠিক হবে না। তাতে দল এবং সংগঠন উভয়েই দীর্ঘমেয়াদীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিষয় অনেক সময় রাজনীতিবিদদের আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। অর্থবিত্ত থাকার কারণেই দলীয় মনোনয়ন পাওয়া যায়; দলকে কিংবা দায়িত্বশীল নেতাকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী প্রদান করা হয়ে থাকে। যদিও সেগুলো অপ্রকাশ্যে হয়ে থাকে। মাঝে-মধ্যে অর্থের মাধ্যমে পদ-পদবী পাওয়ার বিষয়ে মুখরোচক আলোচনা শোনা যায়। এরকম সংস্কৃতি বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলে আসায় কাঙ্খিত কোন নেতৃত্ব কিন্তু তৈরি হচ্ছে না। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা রাজনীতিতে আসছে না। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের রাজনীতির প্রতি অবহেলা একটা সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি করবে।
এসব ক্ষেত্রে দল এবং দলের সিনিয়র নেতাদের দায়সারা ভূমিকাও সমানভাবে দায়ী। কারণ, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের হেঁয় করে ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়ে থাকে। যাদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে কখনোই কোন ভূমিকা ছিল না; তারা যদি ব্যবসায়ী হয়ে দলের ব্যানারে নির্বাচন করার সুযোগ পায় তাহলে রাজনীতিতে থাকার কি দরকার? এরকম ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতির মাঠটা রাজনীতিবিদেদের জন্যই থাকুক, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে মনোনিবেশ করুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কাজেই, ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে মেধাবী ছাত্রদের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করা উচিত।
আমার লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ছাত্রলীগের কাঙ্খিত নেতৃত্বের অপেক্ষায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৃণমূল কর্মী ও সমর্থকরা- এ নিয়ে আলোকপাত করা। কাঙ্খিত বলতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালনকারী, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচর্চার অনুসারী, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী, সংগঠনের নীতি ও আদর্শের পরিপূরক হিসেবে ইতোমধ্যে দায়িত্ব পালনকারী এমন কাউকে সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করাকে বুঝায়। মানবিক গুণসম্পন্ন ও নেতৃত্বে প্রদানের যোগ্যতা সম্পন্ন কাউকে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করা হলে ছাত্র রাজনীতির হৃত গৌরব অনেকাংশে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। যেটি আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যও সুখকর হবে। যে নেতৃত্বকে অনুসরণ ও অনুরণন করে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
ছাত্রলীগের পদ প্রত্যাশী একজন নেতার সাথে কমিটি গঠনের বিষয়ে কথা বলেছি। অনেক কথার ফাঁকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, অর্থ প্রয়োগের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সভাপতি কিংবা সম্পাদকের পদ বাগিয়ে আনা যায় কি? উত্তরে তিনি বললেন: ছাত্রলীগের পদ-পদবী পাওয়া কপালের/ভাগ্যের ব্যাপার। কপাল এবং সৌভাগ্য ছাড়া ছাত্রলীগের শীর্ষপদে পদায়ন সম্ভবপর হয় না। আমি পাল্টা প্রশ্নে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে আপনারাই তো ভাইলীগ কিংবা সিন্ডিকেট তথা দৌরাত্ম্য বাতিল করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মতামত দিচ্ছেন। এর মানেটা কী তাহলে?
উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন: ভাইলীগ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ব্যক্তিক আনুগত্যতার ভিত্তিতে শীর্ষপদে পদায়ন করা, যেখানে দলীয় পরিচয় কিংবা সংগঠনের প্রতি আনুগত্য গৌণ হিসেবে দেখা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সারা দেশে নিজেদের পছন্দমতো কমিটি দিতে পারবে অনুগত ছাত্রলীগ নেতাকে দিয়ে। আর যদি অর্থের মাধ্যমে শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত করা হয় তাহলে পরবর্তীতে আনুগত্য না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তাই শীর্ষপদে অধিষ্ঠানের ব্যাপারে কোনরূপ আর্থিক লেনদেনের বিষয় থাকে না।
ভাইলীগ বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হলে ছাত্রলীগের মূল কাঠামো কিংবা অনুসারীর বাইরে সংগঠনটিতে দল স্বর্বস্ব লোকজন পদায়ন পেয়ে থাকে। দলের বাইরের লোকজন যদি দলে কিংবা সংগঠনে এসে যায় তাহলে দলীয় কর্মকাণ্ড কিংবা অন্যান্য ইস্যু ও রাজনৈতিক দলের সংকটময় মুহূর্তে ঐসব কর্মী ও নেতাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। তারা দলীয় হাইকমান্ডের নীতি আদর্শের প্রতি কোনরূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে দলকে নানাভাবে বিপদে ফেলবার পায়তারা করে থাকে দলে অনুপ্রবেশকারীরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্রলীগ সংক্রান্ত নানামুখী সংবাদে অনুপ্রবেশকারীদের দৌরাত্ম্য ও অপকর্ম ছাত্রলীগকে অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ছাত্রলীগ প্রশ্নবিদ্ধ হলে এর দায়ভার কিন্তু প্রকারান্তারে আওয়ামী লীগকেই নিতে হয়। সাংগঠনিক কোন্দল ও কমিটি গঠনে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশ এবং চাঁদাবাজি সংক্রান্ত নিউজের মাধ্যমে ছাত্রলীগ খবরের শিরোনাম হয়েছে। সাধারণ মানুষ যে ঘটনাগুলোকে নেতিবাচক হিসেবে নিয়েছে, ভোটের রাজনীতিতে সে বিষয়গুলো মারত্মকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই নতুন করে কমিটি প্রণয়নের পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট যথাযথ উপস্থাপনই পারে কাঙ্খিত নেতৃত্ব আনয়নে, হোক সেটি ইলেকশন কিংবা সিলেকশনের মাধ্যমে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)