ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার মাঝেরহাট ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার পেছনে কেউ দোষ দিচ্ছেন মেট্রো প্রকল্পের কাজকে, কেউ আবার অভিযোগ তুলেছেন রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির।
ভেঙে পড়া অংশ তুলতে ঘটনাস্থলের কাছে এসে বসে আছে জেসিবি এক্সকেভেটর বা খননকারী মেশিন। কিন্তু উদ্ধারকাজে কিছুই করতে পারছে না তারা।
ভেঙে পড়া অংশের এক দিকে চলছে মেট্রোর কাজ। অন্যদিকে খাল। সেখান দিয়ে কোনোভাবেই মেশিন ঢোকানো যাচ্ছে না। সে কারণেই উদ্ধার কাজে দেরি হচ্ছে। ধ্বংসস্তুপের ভেতর যদি কেউ আটকে থাকেন, তাদের বেঁচে থাকার আশা ক্রমেই একটু একটু করে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স বা এনডিআরএফ-এর সদস্যসহ স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে হাতে কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাদের হাতিয়ার এখন ইলেক্ট্রিক ডিল মেশিন।
ড্রিল মেশিন দিয়ে ব্রিজের চাঙড়ের উপর বড় বড় গর্ত করে নীচে উঁকি দিয়ে দেখছেন উদ্ধারকারীরা। খোঁজার চেষ্টা করছেন, নিচে কেউ আটকে আছেন কিনা। এছাড়া ভেঙে পড়া উড়াল সেতুর চাঙড়গুলো ছোট ছোট করে ভেঙে কিছুটা সরিয়ে ফাঁকা করেও দেখা হচ্ছে।
এনডিআরএফ কর্মীদের আক্ষেপ, জেসিবি মেশিন ধ্বংসস্তূপের কাছে নিয়ে যেতে পারলে আরও তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করা যেত। সে উপায় নেই, কারণ ভাঙা সেতুর পশ্চিম দিকে মেট্রোর কাজ চলছে। আর পূর্ব দিক বরাবর গিয়েছে খাল।
আবার ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে এক্সকেভেটর নিয়ে গিয়েও সেখানে নামানো সম্ভব নয়।
উদ্ধারকারীদের বরাতে আনন্দবাজার জানিয়েছে, এই যন্ত্র নিয়ে যেতে পারলে বিশাল বিশাল চাঙড় হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। চোখে দেখে বোঝা যেত ধ্বংসস্তুপের নিচে কেউ আটকে আছে কিনা।
সারা রাত ছোট ছোট অংশে ভেঙে চাঙড়গুলো সরিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনডিআরএফ কর্মীরা। চারটি প্রশিক্ষিত কুকুর নিয়ে আসা হয় মঙ্গলবার রাতেই। তারা প্রাথমিকভাবে নিচে কেউ আটকে থাকতে পারেন বলে ইঙ্গিতও দিয়েছিল।
কিন্তু সারারাত এবং সকালে খুঁজেও কারও সাড়া মেলেনি।
বেঁচে ফেরাদের বর্ণনাতীত অভিজ্ঞতা, প্রত্যক্ষদর্শীদের আতঙ্ক
# ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না, বেঁচে আছি। শুধু মনে হচ্ছে, গাড়িটার নিচে কিছু নেই। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি, আর আমরা খাদে তলিয়ে যাচ্ছি।’
এভাবেই নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন ভেঙে পড়া মাঝেরহাট ফ্লাইওভার থেকে বেঁচে ফেরাদের একজন, অশোক মণ্ডল।
অশোকের ভাষায়, ‘মঙ্গলবার বিকেলবেলা বেহালার দিক থেকে ফিরছিলাম। সিটি সিভিল কোর্টের মুখ্য বিচারকের গাড়ি চালাই আমি। মঙ্গলবার দুপুর তিনটার সময় ব্যাংকের কাজে গাড়ি নিয়ে বেহালায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন বিচারকের দেহরক্ষী অনুপম সাউ।
মাঝেরহাট ব্রিজে যখন উঠলাম, সামনে অনেকগুলো গাড়ি। হঠাৎই কানফাটানো বিকট আওয়াজ। বুঝলাম, আমার গাড়ির তলায় আর কিছু নেই। প্রবল ঝাঁকুনিতে আমার শরীরটা লাফিয়ে উঠল। গাড়িটা ঝাঁপ দিয়ে সামনের খাদে পড়ে গেল। তারপরেই সব অন্ধকার।
যখন চোখ খুললাম, তখন আমাকে গাড়ি থেকে বার করছে অনেকগুলো অপরিচিত মুখ। মনে হল, ও কোথায়? অনুপমের নামটাও তখন মনে করতে পারছি না। সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। কথা বলতে পারছিলাম না। ওই অবস্থাতেই আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়।’
পরে জানতে পারেন দেহরক্ষী অনুপমও বেঁচে আছেন।
# মাঝেরহাট ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি মেয়েকে ফোন করেছিলেন বাবা। কারণ রোজ বাসে করে সেখান দিয়েই কলেজ থেকে ভবানীপুরে বাড়ি ফেরেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রান্তিকা গোস্বামী।
উদ্বিগ্ন আত্মীয়দের ভিডিও কল অন্য কেউ একজন ধরলে দেখা যায়, দু’পা সামনে ছড়িয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রয়েছেন প্রান্তিকা। কথা বলার ক্ষমতা নেই তার। উড়ালসেতু ভেঙে পড়ছে বুঝতে পেরে আতঙ্কে হাওড়া-রবীন্দ্রনগর রুটের মিনিবাসটি থেকে তিনি বাইরে লাফ দেন। কাঁধে ও পায়ে চোট পান তিনি।
স্থানীয়রা উদ্ধার করে এসএসকেএমে নিয়ে গেলে পরে প্রান্তিকা জানান, ঝাঁপ দিলেও সেতুর ভাঙা অংশের সঙ্গে নিচেই পড়ে যান তিনি।
# গুলাম মুস্তাফা নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘মহাবীরতলায় ক্লাবের সামনেই বসেছিলাম। হঠাৎ বীভৎস জোরে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড় শুরু করি। চিৎকার করে বন্ধুদেরও ডাকি। ওরাও বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। মাঝেরহাট ব্রিজটাই ভেঙে পড়েছে!
চারদিকটা কেমন লণ্ডভণ্ড অবস্থা। ভেঙে পড়া ব্রিজের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে এক রাশ গাড়ি, বাস, মিনিবাস, বাইক।
ছুটে গেলাম মিনিবাসটার কাছে। ভিতরে লোকগুলো তখন ছটফট করছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। উঠে পড়লাম। এক এক করে সকলকে বার করে আনি আমরা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সকলের শরীর।
প্রত্যেককে এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওদের মধ্যে কয়েক জনের শরীর নিথর ছিল। বাকিরা কে কেমন আছেন, কে জানে!’
মেট্রোরেল প্রকল্পের দিকে উঠছে আঙ্গুল
মাঝেরহাট ফ্লাইওভার ভাঙার কারণ নিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রের মধ্যে চলছে টানাপোড়েন। মেট্রোর কাজের জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? – এমনই প্রশ্ন তুলছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ।
শুধু প্রশাসনই নয়, দুর্ঘটনার পর থেকে স্থানীয়দের অনেকেও মেট্রোর দিকেই আঙুল তুলছিলেন। গুলাম মুস্তাফা বলেন, ‘ইদানিং ব্রিজটা ভীষণ কাঁপত। মেট্রো প্রকল্পের কাজের জন্যই এটা হয়েছে। মেট্রোর ইঞ্জিনিয়ারদেরও এই বিষয়টা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তাতে আমল দেননি।’
যদিও এই ব্রিজ ভাঙার সঙ্গে মেট্রোর প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই বলে রেলের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার রাতে পাল্টা বিবৃতি দেয়া হয়েছে। উড়ালসেতু ভেঙে পড়ার পর থেকেই এ নিয়ে চর্চা হওয়ায় শেষে মেট্রো রেলের তরফ থেকে বিবৃতিটি দেয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মেট্রোর কাজের সঙ্গে ব্রিজ ভাঙার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ যে অংশটি ভেঙে পড়েছে তা দু’টো স্তম্ভের মাঝের অংশ। মেট্রোর কাজের জন্য যদি ক্ষতি হতো তাহলে স্তম্ভের ক্ষতি হতো। কিন্তু ভেঙে পড়া অংশের দু’দিকের পিলারের অবস্থা থেকেই স্পষ্ট, ব্রিজ ভাঙার সঙ্গে মেট্রোর কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তবে এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে যে কোনো সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।
এছাড়া নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে রাজ্য।