কোনো কিছুতেই তাকে ফেরানো গেলো না। তিনি শুনলেন না কোনো মিত্রের পরামর্শ, মানলেন না বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাবধানবাণীও। সব পরামর্শ আর সাবধানবাণীকে উপেক্ষা করেই ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এক্ষেত্রে ইরানের হুঁশিয়ারিকেও পাত্তা দেননি তিনি। এমনকি চুক্তি হওয়ার পর ইরানের ওপর থেকে যেসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল সেগুলো আবারও আরোপ করার কথাও বলেন ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের একটি দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। এমনকি চুক্তিভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোও ইরান লাগামছাড়া হওয়ার উস্কানি পাবে ভেবে উদ্বেগে আছে।
ট্রাম্পের ‘যুক্তি’
২০১৫ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় পশ্চিমা বিশ্বের ছয়টি দেশের সঙ্গে ইরানের করা চুক্তিটিকে ‘ক্ষয়িঞ্চু’, ‘পচনশীল’ এমনকি ‘উদ্ভট’ বলে আখ্যা দিয়ে এর থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেলে হোয়াইট হাউজে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে তার কাছে ইরানের সঙ্গে করা এ পরমাণু চুক্তি লজ্জাকর।
চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কারণ হিসেবে তিনি নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সুরে গলা মিলিয়ে বলেন, ইরান চুক্তির মূলে রয়েছে এক বিরাট মিথ্যা। অবশ্য এ বক্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ না দেখিয়েই একে সত্য বলে দাবি করেন তিনি।
শুধু তাই নয়, পুরো ভাষণ জুড়েই ইরানের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক নানা কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও চুক্তির অন্য পাঁচ দেশের মতে, জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গত তিন বছরে চুক্তির শর্ত মেনেই কাজ করেছে ইরান।
ট্রাম্প বাদে সবাই একজোট
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি একটি যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে হতাশা প্রকাশ করে চুক্তি থেকে বের না হওয়ার জন্য দেশটিকে জোর আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, চুক্তির অন্য দুই সদস্য রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মিলে তারা চুক্তি টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাবে।
চীন এবং রাশিয়াও ইরান চুক্তির প্রতি সমর্থন বজায় রাখবে বলে জানিয়েছে।
সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ
অন্যরা বিপক্ষে বললেও ইসরায়েল আর সৌদি আরব ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানিয়েছে। বহু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের মতে, বন্ধু ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার্থে চুক্তি থেকে সরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার ভোটারদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে এই চুক্তি থেকে সরে আসবেন তিনি।
সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই ট্রাম্প মিত্র দেশগুলোর অনুরোধ আর যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
কী হবে এখন
ট্রাম্প প্রশাসনের এই একটি পদক্ষেপই সম্ভাব্য অনেক জটিল কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এই সমস্যাগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তবে এদের মধ্যে কিছু সম্ভাব্য ফলাফল সবচেয়ে গুরুতর বলে ধারণা করা হচ্ছে:
# চাইলেই পারমাণবিক বোমা বানানোর কাজ শুরু করতে পারে ইরান
ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই বিষয়টি ভেবে দেখতে বলে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসলে ‘ঐতিহাসিক অনুতাপের’ সম্মুখীন হতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ঘোষণাকে অবৈধ অভিহিত করে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান জানায়, এভাবে চুক্তি থেকে সরে যাওয়া আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি অবমাননাকর ও অগ্রহণযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের কারণে এভাবে চুক্তি বাতিল হলে ইরান আবারও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিসহ পরমাণু কর্মসূচি শুরু করবে বলে সতর্ক করেছেন হাসান রুহানি।
তবে চুক্তি যেন বাতিল না হয়, সেজন্য ইরান সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলেও রুহানি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন। বলেন, ‘আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আগামী সপ্তাহগুলোতে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসতে।’
‘আমরা যদি অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সহযোগিতায় চুক্তির লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারি, তাহলে চুক্তিটি (যুক্তরাষ্ট্র না থাকলেও) বহাল থাকবে।’
ট্রাম্পের ঘোষণার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ইরানের পার্লামেন্টে। ক্ষেপে গিয়ে বহু পার্লামেন্ট সদস্য আমেরিকান পতাকা পুড়িয়েছেন। পার্লামেন্টের স্পিকার বলেছেন, ট্রাম্পের ‘মানসিক দক্ষতা’র অভাব রয়েছে।
ইরানের জনগণ, ইরানের সরকার, ইরানের পার্লামেন্ট – সবাই ক্ষুব্ধ। চুক্তি ধরে রাখার চেষ্টার কথা বললেও চেষ্টা ব্যর্থ হলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর কাজ শুরু করতেই পারে। কোনো চুক্তি তখন আর থাকছে না তাদের ঠেকাতে।
# শক্তিধর সব বন্ধু হারাতে পারে ‘শক্তিশালী’ আমেরিকা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান চুক্তি থেকে সরে আসা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজের অনেক বড় ক্ষতি করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। জাতিসংঘ প্রধান অ্যান্টোনিও গুতেরেস ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ তাকে বুঝিয়েছিলেন।
এমনকি শেষ মুহূর্তে ট্রাম্পকে বোঝাতে ওয়াশিংটনে ছুটে যান যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। ইরান চুক্তি নবায়ন করে নর্থ কোরিয়ার সঙ্গেও একই ধরনের কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারলে ট্রাম্প শান্তিতে নোবেলও জিতে নিতে পারেন বলে লোভ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন বরিস।
কিন্তু কারও কথা না শুনে ‘তালগাছ আমার’ নীতিতেই অটল রইলেন ট্রাম্প। আর এখন তার সঙ্গ ছেড়ে পাঁচ বিশ্বনেতাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন জানাচ্ছে ইরানকে। এর ফলে প্রয়োজনের সময় যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুদের আর পাশে না-ও পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
# ব্যাহত হতে পারে সম্ভাব্য নর্থ কোরিয়া চুক্তি
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তি থেকে হুট করে বেরিয়ে এসে আবার ইরানের ওপর পুরনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আসন্ন নর্থ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিক বৈঠকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ধরা যাক, এতদিন ধরে চরম শত্রু থাকা, যুক্তরাষ্ট্রের বহু দফা অবরোধের আওতাধীন নর্থ কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণ আলোচনার পর হয়তো দুই দেশ মিলে একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তিতে পৌঁছাল। কিন্তু হুট করে ইরান চুক্তির মতোই ট্রাম্প সরে এলেন সেই চুক্তি থেকেও… তখন?
নর্থ কোরীয় নেতা কিম জং উনের মধ্যে এ চিন্তা বাসা বাঁধলে তা যে কখনোই কিম-ট্রাম্প বৈঠকের জন্য ইতিবাচক হবে না তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।
এতগুলো আশঙ্কাজনক সম্ভাব্যতার মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে কোনদিকে নিয়ে যাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।