প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখনিতে সমকালে তার সমকক্ষ বিরল। মৌলবাদ-প্রতিষ্ঠান-সংস্কার বিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক দৃঢ় সৃষ্টিতে অভিভূত, বিস্মিত করেছেন পাঠকদের। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে পরিহার করে সাহসী বক্তব্যের জন্য ১৯৮০’র দশক থেকেই তুমুল আলোড়ন তুলেছিলেন। তবে তাকে গ্রহণ করতে পারেনি দেশের কট্টরপন্থী-প্রতিক্রিয়াশীলরা। যার রচনায় থাকে চিরাচরিত অন্ধকারের বিরুদ্ধে তীব্র আলোর রোশনাই, তিনি নিশ্চয় সর্বজন সমাদৃত হবেন না। কিন্তু সকল হুমকি, বাধার বিপরীতেও তিনি ছিলেন, প্রবলভাবেই ছিলেন। বাংলার সাহিত্য দর্শন, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনায় তীব্র আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি ড. হুমায়ুন আজাদ। আমাদের জীবনে জড়িয়ে থাকা প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল-কুসংস্কারের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রচণ্ডভাবে তার লেখনি দিয়ে। তার লেখা এমনই, যেনো সকল জরা, অন্ধকারের বিরুদ্ধে এক তীব্র অাদর্শিক চিৎকার।
কেনো তাকে প্রথাবিরোধি বলা হয়? সমাজে বিদ্যমান তাবৎ কুসংস্কার, ভণ্ডামি, আপোসকামীতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সরব। শুধু লেখায় নয়, তিনি বলতেনও সরাসরি কূপমুণ্ডকতার বিরুদ্ধে। তার লেখায় কথায় যেনো আমরা উনবিংশ শতকের রেনেসার উজ্জ্বল আলোর চ্ছটা দেখতে পাই।শুধু প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম ব্যবসায়ীরা নয়, সমাজের সুবিধাবাদী সুশীল সমাজও তাকে অপছন্দ করত তার তীব্র আক্রমণাত্মক বাক বৈশিষ্ট্যের জন্য।
বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি, সমালোচক, ভাষা বিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কিশোর সাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক ড. হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী এই লেখক ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে রাঢ়িখালে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘাতকদের নির্মম আক্রমণ থেকে বাঁচলেও সে বছরেরই ১২ আগস্টে জার্মানিতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টির বেশি। এর মধ্যে ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়।
১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে গোটা দেশে আলোড়ন তুলেছিলেন, যা ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টির কথায় প্রথম দিকেই আসতে পারে এই ‘নারী’। বাংলাদেশ তথা বিশ্বেই নারীদের অপরীসিম অবরুদ্ধতার বিরুদ্ধে লেখনিতে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
‘নারী’ বইয়ের ওপর চার বছরের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বই নিষিদ্ধের জন্য যে দশটা লাইন উল্লেখ করা হয়েছিলো, এর চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর কথা বইতে আছে। এই বই পড়ার ক্ষমতা, শক্তি দেশের ক্ষমতাবান গোষ্ঠির নেই বলেও তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন।
এছাড়াও নারীদের প্রবল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার নানা সাহিত্যে। নিজের স্বপ্ন বা ধারণার সমন্বয়ে গড়েছেন এক একজন ইস্পাত দৃড় নারী চরিত্র। তার ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’এর (২০০১) নায়িকা কি অবলীলায় স্বামীর সংসার ত্যাগ করে আসতে পারেন। দৃড় আর বলিষ্ঠভাবে বলতে পারে, কিছুই আর আগের মতো রবে না। তার ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’ এর নায়িকা কি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয় তার উপর আরোপিত এই বর্বর নির্যাতনের। বাংলা সাহিত্য জগতে তার এমন ভয়ঙ্কর সংস্কার বিরোধী রচনা বিস্ময়কর।
১৯৯৪ সালে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথম উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’-এর মধ্যে দিয়ে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’। আর এই বইয়ের জন্য তিনি বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পেয়েছেন।
২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’। বইটিতে ইসলামি জঙ্গিদের যে বিভৎস রূপ তিনি এঁকেছিলেন তা ভয়ঙ্কর, তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে দেয় এই কীটদের প্রতি। অন্য অনেক গ্রন্থের মতো তার এই বইও সমালোচিত হয়। মৌলবাদীরা তাঁর উপর ক্রুদ্ধ হয়। রাজপথ থেকে একসময় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংসদে। মৌলবাদীরা প্রকাশ্যে তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক বাংলা ভাষা-ব্যাকরণেও রেখেছেন অসামান্য অবদান। তার রচিত কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭), লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী (১৯৭৬) বইগুলোতে অসাধারণ গল্পের ছলে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে বাংলা ভাষার ইতিহাস। এছাড়াও ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রয়েছে তার।
সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়েই যেনো এসেছিলেন। তুমুলভাবে আলোড়িতও করেছিলেন। বৈষয়িক ছিলেন না, তা তার স্ত্রী লতিফা কোহিনূরের একটি কথাতেই স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছিলেন, বই ছাড়া তিনি (হুমায়ুন আজাদ) কিছুই রেখে যাননি।
তার কবিতাগুলোও ছিলো অসাধারণ সমসাময়িক। তার প্রেমের কবিতাগুলো, তার বিদ্বেষ, তার কষ্টগুলো যেনো এক কান্নার আবরণ তুলে দেয় পাঠকদের মাঝে। প্রেয়সীর স্মরণে তিনি বলতে পারেন,
“আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।”
প্রেমের শুদ্ধতা আর নিয়মসিদ্ধ সম্পর্ককেও কি তীব্রভাবে পার্থক্য করে বলতে পারেন,
“তুমি যাকে দেহ দাও, তাকে গাধা করো
তুমি যাকে স্বপ্ন দাও, তাকে সোনা করো !”
এই অসামান্য স্রষ্টার আজ জন্মদিন। খুব অসময়ে এসেছিলেন তিনি। এসেছিলেন ‘নষ্টদের সময়ে’। লিখেছিলেন “আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে/নষ্টদের দানব মুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/সব সংঘ পরিষদ”।
বিদ্যমান সমাজের সাম্প্রতিক নষ্ট রাজনীতির বহুমুখী আপোসকামীতায় তাকে মনে পড়ে। দেশের সার্বিক অবস্থায় তিনি প্রতিদিন অনিবার্য হয়ে উঠছেন। যাপিত কালের নষ্ট সময়ে তাকে খুব মনে পড়ে, তিনি আমাদের এই ভবিষ্যদ্বানী করে গেছেন যে, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। কী অসহ্য সত্য উচ্চারণ করে গেছেন সমস্ত প্রতিকূলতার ভেতর থেকে। জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন আমরা জাতীয় জীবনে কী পঙ্কিলে নিমজ্জমান।
এই নষ্ট সময়টা তাকে ধারণ করতে পারেনি। নিজের উপলব্ধিও হয়তো তেমন ছিলো তার। তাই লিখেছিলেন “আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)