একসময় চরম অবহেলার শিকার দেশের পর্যটন খাত নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিপুল পরিমান বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের মনোযোগে এই অগ্রগতি বলে জানিয়েছেন এখাতের সংশ্লিষ্টরা। তবে দৃশ্যমান কিছু সমস্যা-প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনও আশানুরুপ সেবা দিতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে তাদের মধ্যে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া ৩ দিনব্যাপী ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজম ফেয়ার-২০১৭’ এ অংশ নেয়া পর্যটনখাতের উদ্যোক্তারা আর আয়োজকরা চ্যানেল আই অনলাইনকে এমনটিই জানিয়েছেন।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের বহু দেশ প্রমাণ করেছে, পর্যটন অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ অর্জিত হয় এখাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান অংশ পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবেশি দেশ ভারতে যেখানে প্রতিবছর ৫০ লাখ বিদেশী পর্যটক ঘুরতে যান, নানা সংকটে জর্জরিত মিয়ানমারে যায় বছরে দশ লক্ষাধিক বিদেশী পর্যটক, তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এই খাতে কাজ করা উদ্যোক্তারা আয়োজন করেছেন পর্যটন মেলার। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট (বিএফটিডি) আয়োজিত এবারের মেলাতে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়াসহ ৮ দেশের ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান এবং দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ১০৬টি স্টল রয়েছে।
মেলার অন্যতম আয়োজক ও বিডি ইনবাউন্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাদরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, পর্যটন খাতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই খাতে কাজ করা। উদ্যোক্তরা প্রথমে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো কাজ করলেও এখন বেশ দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে। প্রতি বছর বছর মেলাতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধিসহ দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেখলে তা বোঝা যায়। তবে পর্যটন বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর আন্তরিক হয়, তবে আমাদের কষ্ট কিছুটা কমবে এবং এই খাতের আরও উন্নতি হবে।
প্রায় একইরকম জানালেন আরেক আয়োজক ও চেজ রাজ্জাক ট্যুরস ও ট্রাভেলের প্রধান নির্বাহী এম.এ. রাজ্জাক। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, এই মেলাতে মাননীয় মন্ত্রীর উপস্থিতি আর কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল নিয়ে অংশগ্রহণ ছাড়া প্রায় সবকিছুই আমাদের করতে হয়েছে। তাদের বাজেট আছে, কাজের নির্দিষ্ট লক্ষমাত্রা আছে, সেসবের সঙ্গে যদি আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের পর্যটন বিষয়ক কর্মকাণ্ডে তারা আরও সক্রিয় হলে সবারই উপকার হয়।
এবারের মেলা উদ্বোধন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকে ট্যুরিস্ট প্রোডাক্ট হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানান। আগামি ওআইসি সম্মেলনে দেশীয় ধর্মীয় হেরিটেজগুলো তুলে ধরা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রীর কথার মধ্যে দারুণ সম্ভাবনা দেখার পাশাপাশি কিছু হতাশার কথা জানান টোয়াবের ফার্ষ্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্ট্রেইটওয়ে ট্যুরের প্রধান নির্বাহী মো. রাফিউজ্জামান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, দেশে যেসব ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, মন্দির ও বৌদ্ধ স্থাপনা আছে তা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারলে এ খাতের চেহারা পাল্টে দেয়া যেতো। তাছাড়া আমাদের সুন্দরবন ও কক্সবাজারতো রয়েছেই। তবে পর্যটন এলাকাগুলোতে বিদেশী পর্যটকদের প্রাইভেসি সুবিধা বাড়াতে হবে। যেমন করেছে মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড।
বিদেশী পর্যটকদের দেশে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ঘটনা একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে এ বিষয়ে গণমাধ্যমসহ সরকারকে আরও যত্নবান হবার পরামর্শ দেন তিনি।
মেলাতে পর্যটন বিষয়ক সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখ করার মতো আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের স্টল।
সেখানে দেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, মন্দির ও বৌদ্ধ স্থাপনা নিয়ে নানা প্রকাশনা ও তথ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের আগ্রহ থাকলেও বিক্রি ও বিতরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক।
আরও রয়েছে টুরিস্ট পুলিশের স্টল। যারা বিভিন্ন স্পটে তাদের উপস্থিতির বিষয়টি জানান দিচ্ছেন মেলার মাধ্যমে।
এইসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও হতাশ নয় তরুন উদ্যোক্তারা। তারা অনেক সময় নিজ খরচে, যোগাযোগে ও সরকারি সাহায্য ছাড়াই বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন দেশের পর্যটন সমৃদ্ধিকে।
মেলায় অংশ নেয়া পর্যটনখাতের তরুণ উদ্যোক্তা ট্র্যাভেলি.কম.বিডি ও এক্সপ্লোর হলিডেজের প্রধান নির্বাহী আতাউর রহমান অনিক বলেন, দেশের মানুষের বিদেশ ঘুরতে যাবার অভ্যাস অনেকদিনের। সেসব কাজ করতে করতে বিদেশে যাওয়া আর সেখান থেকেই বিদেশী পর্যটকদের দেশে আনার কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের দেশের সৌর্ন্দয্য ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রায়ই নিজেদের খরচে বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ারে অংশ নেবার চেষ্টা করি। সেইসূত্রে অনেক বিদেশী পর্যটক এখন দেশে আসছে।
সেইসঙ্গে তিনি ট্রাভেল করার সময় ইন্সুরেন্স করার সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান। চীনের অনেক ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের দেশে আনতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ও সফালতা পাচ্ছেন বলেও সন্তোষ প্রকাশ করেন।
আরেক তরুণ উদ্যোক্তা ট্যুরিজম উইন্ডেজের প্রধান নির্বাহী মো. মনিরুজ্জামান মাসুম চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, বিদেশী অনেক ট্যুর অপারেটর ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে করতে এখন আমরা তাদের সঙ্গে পর্যটক একচেঞ্জ প্রোগ্রামের মতো কাজ করছি। তাদের পাঠানো পর্যটকদের আমরা সেবা দিচ্ছি, আর আমাদের পাঠানো পর্যটক তারা। এরফলে উভয়েই উভয়ের ব্যবসায় যেমন ভুমিকা রাখতে পারছি তেমনি পর্যটকরাও ভাল সেবা পাচ্ছে।
মনিরুজ্জামান মাসুমের মাধ্যমে এবারের মেলাতে ভারত, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেলাতে অংশ নিয়েছে।
পর্যটনখাতের সেবা দিতে পিছিয়ে নেই নারী উদ্যোক্তারাও। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় মিশর ভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্সি বেনু ট্রাভেলের কান্ট্রি ম্যানেজার শিমুল বেগমের সঙ্গে। অনেকবছর হলো তিনি এই খাতে কাজ করে যাচ্ছেন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, মেলার মাধ্যমে আমাদের কাজের পরিচিতি তুলে ধরতে পেরে ভাল লাগছে। মিশরসহ কিছু দেশে পর্যটক পাঠানো নিয়ে আমরা কাজ করি। মিশরে পর্যটক পাঠানো যেমন একটু কঠিন, তেমনি মিশরীয়রা বাংলাদেশ সর্ম্পকে একটু ‘সুপিরিয়র কমপ্লেক্স’ এ ভোগে বলে তাদের আনাটাও কঠিন। এছাড়া বাংলাদেশের ভিসা দেবার সময় নিয়ম মোতাবেক মিশরীয়দের কাছ থেকে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়, তা তারা দিতে চায় না বলেও অনেকসময় আসে না।
নারী হিসেবে এইখাতে কাজে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না জানিয়ে এইখাতে নারীদের আরও যুক্ত হবার আহ্বান জানান তিনি।
মেলাতে উপস্থিত বিদেশী স্টলের মধ্যে ভারতের আসাম রাজ্যের ট্যুরিজম বোর্ড অংশ নিচ্ছে। এছাড়াও আছে কলকাতা, কাষ্মীর ও শিলং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তারা বাংলাদেশের পার্টনার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেলায় অংশ নিচ্ছেন বলেও জানান।
থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরাও একই রকম জানালেন। তারা বাংলাদেশ থেকে পর্যটক নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেশের পর্যটকও পাঠাচ্ছেন।
মেলায় রিয়েলস্টেট ট্যুরিজম বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট ও রিসোর্ট বিক্রির অফার দিচ্ছে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের স্টল, মেলা উপলক্ষে তাদের রয়েছে কিছু অফার।
পর্যটন বিষয়ক তথ্য ও ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ভ্রমণসঙ্গী’ স্টল নিয়েছে মেলাতে। তাদের সুন্দরবন বিষয়ক তথ্যবহুল একটি আকর্ষনীয় পুস্তিকা মেলায় প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে। স্টলে থাকা পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম রেজা জানালেন, বিভিন্ন রিসোর্ট ও পর্যটন স্পটের উপরে একটি গাইড আছে তাদের। যা বেশ জনপ্রিয়।
এইখাতের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সহায়তা পেলে ‘ভ্রমণসঙ্গী’ পত্রিকার কার্যক্রম আরও বাড়ানোর ইচ্ছে আছে বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান পত্রিকাটির সম্পাদক মিজানুর রহমান।
১২ আগস্ট (শনিবার) পর্যন্ত চলবে এই মেলা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ মেলায় প্রবেশ করতে ৩০ টাকার টিকেট কাটতে হবে।