৭৫ হাজার কোটি টাকার ঈদ উৎসব হচ্ছে বাংলাদেশে। ঈদ অর্থনীতির আকার কত তা নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো জরিপ নেই। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে এই সংখ্যাটি জানিয়েছে দ্যা ডেইলি বাংলাদেশ অবজারভার। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, গত বছর দুই ঈদে বাংলাদেশ খরচ করেছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির আকার বড় হওয়ায় আগামী ৬ বা ৭ তারিখের ঈদে ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে প্রাক্কলন করেছে আন্তর্জাতিক এই ব্যাংকটি। দোকান মালিক সমিতির হিসেবও একই। তারা বলেছেন এর মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে তৈরি পোশাক ক্রয়ে, ৫ হাজার কোটি টাকা ফুটপাতে এবং বাকী ১০ হাজার কোটি টাকা অন্যান্য বস্তু ক্রয়ে এবং পরিবহণ খরচ বাবদ।
ঈদ অর্থনীতিতে এই বাড়তি টাকার যোগান দেবে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে কর্মরত মানুষের বোনাস, বকশিস, ঈদ খরচের জন্য বিদেশ থেকে পাঠানো বাড়তি রেমিটেন্স এবং ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের বাড়তি মুনাফা। গত বছর দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন জানিয়েছিল, উৎসবের মোট খরচের ৭০% করে ধনী লোকেরা। বাকীটা খরচ করে মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র লোকেরা। ধনী পরিবারগুলো ২০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত একেক উৎসবে খরচ করে। এই খরচের একটা বড় অংশ উপহার, সাহায্য এবং যাকাত হিসেবে গরীব মানুষদের হাতে চলে যায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বা ত্বরান্বিত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে ক্রমাগত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যত বেশি হবে, উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা তত বেশি হবে। চাহিদা বেশি হলে তা মেটানোর জন্য উৎপাদকেরা তত বেশি পণ্যের যোগান দেয়ার চেষ্টা করে, নতুন নতুন পণ্য এবং উৎপাদকের সৃষ্টি হয়। পণ্যের লেনদেন যত বেশি হবে, অর্থনীতি তত বেশি শক্তিশালী হবে, বেশি সঞ্চয় হবে এবং বেশি বিনিয়োগ হবে। বেশি বিনিয়োগ মানে আরও বেশি উৎপাদনের ব্যবস্থা। অতিরিক্ত ৭৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন জাতীয় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে; এগিয়ে নিয়ে যায়।
নববর্ষ, ঈদ, কোরবানী, পূজা, পার্বন অর্থনীতিতে বাড়তি গতিশীলতা আনায়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের পূনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করে। সামাজিক উৎসব সম্পদ বৈষম্য রোধে কিছু ভূমিকা পালন করে। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে যে বিদ্যমান সম্পদ বৈষম্য রয়েছে তা কিছুটা কমিয়ে সমাজকে বসবাসযোগ্য রাখতে উৎসবের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার এ হচ্ছে এক প্রকার মলম যা দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্ষতের উৎসের চিকিৎসা না করে উপরিভাগের কিছুটা উপশম করা সম্ভব। উৎসবের সময়ে সচ্ছল এবং ধনী ব্যক্তিরা অঢেল খরচ করে নিজেদের অর্থ-বৈভবের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজেদের সামাজিক মান-সম্মান বাড়ানোর চেষ্টা করে। এর ফলে অর্থনীতি সচল হয় এবং সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিদের হাতে সঞ্চিত সম্পদের কিছু অংশ দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছায়।
দেশের অর্থনীতির কেন্দ্র হচ্ছে শহর। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগ অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে সারা দেশ থেকে সাধারণ মানুষ জীবিকার অন্বেষণে বড় শহরগুলোতে চলে আসে। এদের মধ্যে প্রায় সবাই সারাবছর বড় শহরে বসবাস করলেও উৎসবের সময়টা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে একসাথে থাকতে চায়। তাই সারা পৃথিবীতেই দেখা যায় উৎসবের সময় রাস্তা-ঘাটের শত ভোগান্তি উপেক্ষা করে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনে দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিবেশে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘরে ফেরে। সারাবছর ধরে এই লোকেরা শহরে যা আয় করে তার একটা অংশ এবং বোনাস, বকসিশ মিলিয়ে বেশ ভালো একটা অংক দিয়ে জামাকাপড়, খাদ্যদ্রব্য কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহর খালি করে তারা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। বাড়ি ফিরে তা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীর সঙ্গে তা ভাগ করে নেয়। অর্থাৎ শহরের টাকা গ্রামে চলে যায়। এটাও সম্পদের পূনর্বণ্টন।
সম্পদের পূনর্বণ্টনের এই ধারাটি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। প্রাচীন ভারতে, চিনে, মিশরে, গ্রীসে, রোমে, আরবে সামাজিক উৎসব প্রচলিত ছিল। যজ্ঞ এবং বলির আয়োজন করা হতো দেশে দেশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর আয়োজন করতেন সম্পদশালী ভূস্বামী, রাজা এবং তাদের আমত্যবর্গ। ব্যবসায়ীরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থে যাগ-যজ্ঞের বা বলির আয়োজন করতেন। ভূস্বামী এবং রাজ-রাজারা অনেক ক্ষেত্রেই স্ব স্ব রাজত্বের মধ্যে বসবাসরত বিত্তবানদের কাছ থেকে এক রকমের কর আদায় করে তার সঙ্গে নিজস্ব তহবিল যোগ করে বিশাল, ব্যাপক আনন্দ-উৎসবের খরচ জোগাড় করতেন। এর কোন কোনটাতে উপস্থিত হতো লক্ষাধিক মানুষ। কয়েক দিন ধরে চলা এই আয়োজনের মধ্যে খাওয়া-দাওয়াতো ছিলই, তার সঙ্গে থাকতঃ গান-বাজনা, নৃত্য, ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, নাটক, যাত্রা। উৎসব শেষে আয়োজকের পক্ষ থেকে দেয়া রকমারী উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরত অংশগ্রহণকারীরা। এর একটি ছোটখাট সংস্করণ দেখা যায় কুষ্টিয়ার লালন আখড়ায়। সেখানে এখনো দূর-দূরান্ত থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে সাত দিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলে আসে হাজার হাজার লালন ভক্তরা। লালন সঙ্ঘের আয়োজকেরা সরকারের অনুদান এবং বিত্তবানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এই বিশাল উৎসবের খরচ মেটান। এসব উৎসবের মধ্য দিয়ে ধনী ব্যক্তিদের হাতে সঞ্চিত অতিরিক্ত অর্থের কিছু অংশ গরীবের কাছে চলে যায়; সম্পদের পূনর্বণ্টন হয়।
উৎসব অর্থনীতির এক বড় উপাদান হচ্ছে নগদ বণ্টন। প্রায় সকল উৎসবেই নগদ বণ্টনের ব্যবস্থা থাকে। যাগ-যজ্ঞ, পুজা-পার্বনে থাকে আবার ঈদেও থাকে। ঈদের নগদ বণ্টন দুই প্রকারঃ সেলামি এবং যাকাত। এবারের ঈদে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা পরিমাণের যাকাত বণ্টন হবে দরিদ্র মানুষের মধ্যে। যাকাতের টাকা দিয়ে লুঙ্গি এবং শাড়ী কিনে তা বিতরণের রেওয়াজ রয়েছে বাংলাদেশে। শত শত মানুষ ডেকে যাকাত বণ্টন করা একটা লোক দেখানো ব্যাপার যা ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রতি বছর যাকাতের শাড়ী-লুঙ্গি বণ্টনের সময়ে অব্যবস্থাপনার কারণে বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। এই মৃত্যু ইচ্ছাকৃত নয় বলে এর বিচারও ঠিকভাবে হয় না। অথচ এর জন্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। আইন করে এভাবে যাকাত বণ্টন নিষিদ্ধ করা উচিৎ। যাকাতের টাকা এমনভাবে দেয়া উচিৎ যাতে সেই টাকায় একটা পরিবার স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে।
অনেকে টেকসই উপায়ে যাকাত দেয়ার জন্য উপযুক্ত পথ খুঁজে পান না। এ ক্ষেত্রে সরকারের করনীয় রয়েছে। সরকার অতীতে যাকাত ফান্ড গঠন করে যাকাতের টাকা সংগ্রহ করেছে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে সেই টাকা ব্যবহার না হওয়ায় যাকাত ফান্ড জনপ্রিয়তা পায়নি। যাকাত ফান্ডে জমা হওয়া টাকা দারিদ্র দূরীকরণ এবং সামাজিক সাম্য আনায়নের জন্য গঠিত প্রকল্পে খরচ করা দরকার স্বচ্ছতার সঙ্গে। এ অর্থ কৃষি এবং শিল্প খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় কুটির শিল্পে বিনিয়োগ হলে। এতে কর্মসংস্থানের পথ অনেকটা বেড়ে যাবে; বেকারত্ব কমবে। আরেকটা বিকল্প হতে পারে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাকাতের টাকা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। তার ফলে সামাজিক সমস্যাগুলোর মূলে গিয়ে সমাধান করা সম্ভব হবে। বর্তমানে মসজিদ, মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং যাকাতের টাকা গ্রহণ করে। স্কুল-কলেজ এই টাকা নিতে পারে না। বেশিরভাগ মসজিদ, মাদ্রাসা এই টাকা নিয়ে ধর্মান্ধ তৈরি করে, জঙ্গিবাদ উৎসাহিত হয়। বছর শেষে যাকাতের টাকা যেসব ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে তার অর্জন এবং আয়-ব্যয়ের হিসেব জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে যাকাত ফান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়বে।
আবহমান বাংলায় চৈত্র মাস অর্থনীতির সমাপনী মাস হিসেবে কাজ করে আসছে। কর্পোরেট দুনিয়ায় চলছে ডিসেম্বর সমাপনী। সরকারি হিসেব-নিকেশ করা হয় জুলাই-জুন অর্থ বছরের হিসেবে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র-সংক্রান্তিতে সকলে ধার-দেনা শোধ করে নতুন বছর শুরু হতো। পহেলা বৈশাখে নববর্ষের আয়োজন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও অর্থনৈতিক লেনদেনের একটা বিরাট অংশের সমাপনী হয় এখন রমজানে। এ মাসে যার যার বকেয়া পরিশোধ করে ঈদের আগে লেনদেন সম্পন্ন করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বাঙালির জীবনে ঈদ অর্থনীতির এই নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। এর ফলে রমজানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় অতিরিক্ত ট্রাফিক জ্যামে।
ঈদ অর্থনীতির খারাপ দিকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চাঁদাবাজি এবং অতিরিক্ত দুর্নীতি। পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানেরা ঈদ উপলক্ষে এমনভাবে চাঁদা চায় যে মনে হয় এ টাকা তার পাওনা। ঈদ সামনে রেখে দুর্নীতি এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। অফিস আদালতে রমজানে দুর্নীতির রেট বেশি। ফুটপাতের হকারদের এ মাসে চাঁদা দিতে হয় প্রায় হাজার কোটি টাকা। মোট দুর্নীতির পরিমাণ এ মাসে ঠিক কত তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ হিসেব দেয় নি। দুর্নীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের জন্য এটা একটা ভালো বিষয় হতে পারে।
রমজানে মানুষের হাতে বাড়তি আয় থাকে বলে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা কাজে লাগায়। চলতি মুদ্রাস্ফীতি যেখানে ৬ শতাংশের নিচে সেখানে রমজানের মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে জামা, কাপড়, জুতা, টুপি সবকিছুতেই অতিরিক্ত দাম। ঢাকায় যে পাঞ্জাবি ১,০০০ টাকায় বিক্রি হয় চট্টগ্রামে গিয়ে তা ৩,০০০ টাকা হবার খবর গণমাধ্যেমে আলোচিত হয়েছে। পরিবহন খাতের অবস্থা আরও খারাপ। সাধারণ ভাড়ার ২/৩ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ি যেতে হয় যাত্রী সাধারণকে। এই অবস্থা শুধু সড়ক পথেই নয়, বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয় ট্রেনের টিকেট কালোবাজারীর মাধ্যমে, নৌ-পথে, এমনকি আকাশ পথেও। আভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো এ মাসে কমছে-কম ডাবল ভাড়া আদায় করে; কোনো কোনো রুটে আরও বেশি। এই বাড়তি মূল্য আদায় এক প্রকার চাঁদাবাজী বটে।
রমজানে সাধারণ মানুষের বাড়তি আয় যা হয় বাড়তি দামের কারণে শেষমেষ তার একটি বড় অংশ অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায়। অতি মুনাফা ভালো জিনিস নয়। অতি মুনাফার ফলে উৎসব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য- সম্পদের পূনর্বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কাজটি এতে বাঁধা পায়। রমজান মাসে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা করতে না পারে তা নিশ্চত করার দ্বায়িত্ব রয়েছে সরকারের। ক্রেতাদের রয়েছে সচেতনতার অভাব। ভোক্তা অধিকার রক্ষার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তারা এগিয়ে এলে উৎসবের আনন্দ বেড়ে যাবে আরও অনেক গুণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)