‘পৃথিবীর যা কিছু চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ আর্মেনিয়ায় এসে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের এই বাণী ‘অসাড়’ মনে হচ্ছে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইয়েরেভানের বিমান এবং এরপর ইয়েরেভানে অবতরণের পর কয়েকদিন ধরে আর্মেনিয়ার যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই মেয়েদের আধিপত্য দেখছি। প্রায় সকল কাজে তরুণীদের উপস্থিতি দেখে বিস্মিত হচ্ছি। পুরুষের ভূমিকা এখানে ক্ষীণ মনে হচ্ছে।
ইয়েরেভানগামী বিমানে কোন পুরুষ কর্মচারীর দেখা মেলেনি। গায়ের রং, শারীরিক গঠন এবং আচরণে মনে হলো দু’জন এশিয়ান, একজন আফ্রিকান এবং তিনজন আর্মেনিয়ান। এরপর বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেলো। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটায় আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি আমরা। এসময় ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে যাবার পথে সুন্দরী তরুণীদের উপস্থিতি দেখলাম। অষ্টাদশীর বেশি হবে না।
এখানকার বিমানবন্দরে কর্মরত প্রত্যেকের দারুণ একটি ড্রেস কোড দেখলাম। সাদা-কালো পোশাক। শ্বেত বর্ণের মেয়েদের এই পোশাকে আরো দারুণ দেখায়। ইমিগ্রেশনে সবাই নারী কর্মচারী, কোন পুরুষ নেই। আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসব আয়োজক কমিটির একজন সদস্যের বিমানবন্দরে গেটে থাকার কথা। ইমিগ্রেশন শেষ করে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দুজন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তার মধ্যে একজন তরুণ। অন্যজন তরুণী।
দীর্ঘদেহী তরুণীর নাম আর্মেনি মুহতাসিনা। দেখতে যে অপূর্ব সুন্দরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তরুণ বাগরাত গাড়ি চালাচ্ছেন আর মুহতাসিনার সঙ্গে চলছে আমাদের কথোপোকথন। অনেক কথা হলো।
মুহতাসিনা অনেক কাজ করেন। এক মিনিটও বসে কাটান না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করছেন। পাশাপাশি একজন আর্টিস্ট। ইয়ুথ থিয়েটারে আছেন। সেইসঙ্গে ইয়েরেভানের একটি সুপার শপে জব করেই নিজের খরচ চালান।
বাগরাত আর মুহতাসিনা গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য বুকিং করা হোস্টেল পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। পুরো ইউরোপজুড়েই হোস্টেল ব্যবস্থা দারুণ। কম খরচে সুব্যবস্থা। আমরা রাফায়েল স্টেলের এক রুমে দু’টি সিট ভাড়া নিয়েছি। ১২ হাজার এমডি দুই রাত। আমাদের উৎসব শুরু হবে ২২ জুলাই থেকে। চলবে ২৬ জুলাই। আর আমরা আর্মেনিয়ায় চলে এসেছি ১৯ তারিখ। কাজেই ১৯ আর ২০ জুলাই থাকতে হবে নিজের খরচে। ২২ থেকে ২৬ জুলাই আয়োজকদের অধীনেই সবকিছু।
যে হোস্টেলে উঠেছি সেটি আদতে খারাপ না। এর সাথে আমাদের দেশের হোস্টেলের সঙ্গে তুলনা করলে মারাত্মক ভুল হবে। এসি রুম, ওয়াইফাই ফ্রি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বাথরুম, বড় রান্না ঘর। যার ইচ্ছা রান্না করে খেতে পারেন।
হোস্টেলে উঠে ফ্রেশ হলাম। এরপর রাতের খাবারের জন্য বের হলাম ইয়েরেভান শহরে। এই শহর দেখি ঘুমায় না। গভীর রাতেও নারী-পুরুষ ঘুরছেন। পাবলিক স্কয়ারে গিয়ে নারী-পুরুষের চরম উন্মাদনা দেখলাম। রাতের বেলায় তারা নিরাপদ এবং গোছানো এই শহরে ঘুরাঘুরি করেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হোস্টেলের রিসিপশনে গিয়ে কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে দেখা। বেশ সুন্দরী দেখতে। একজনের সঙ্গে কথা হয়। স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন তিনি। পাশাপাশি এই হোস্টেলে জব করেন। তার কথায়, এখানকার প্রত্যেকে তরুণী পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের খরচ নিজে চালানোর জন্য জব করেন। কেউ মুখাপেক্ষী নন। সবাই যার যার মতো স্বাধীন। কথাগুলো শুনতেই ভালো লাগলো। যেদিকে যাচ্ছি তার কথার সত্যতাও পাচ্ছি।
সকালে নাস্তার জন্য বের হয়ে রেস্টুরেন্টেও গিয়ে দেখি সবাই নারী। ইয়ুথ থিয়েটারে গিয়ে দেখি সেখানেও সবাই নারী। উৎসবের সংবাদ সম্মেলনে গেলাম দেখি সবাই নারী সাংবাদিক। এভাবে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, থিয়েটার, শপিংমল সবখানে নারীদের প্রাধান্য। আমরা সাখকাদজরের বিলাসবহুল যে আবাসিক হোটেলে উঠেছি সেই হোটেলের একজন কর্মচারিও পুরুষ দেখলাম না। সবাই নারী। রাস্তায় হাঁটতে গিয়েও পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি চোখে পড়লো। বারবার বিস্মিত হচ্ছি। কেন যেন মনে হচ্ছে নারীর সংখ্যা এই দেশে পুরুষের চেয়ে বেশি।
মীর লোকমানকে একবার বলেও ফেললাম- ‘এদেশে বোধ হয় নারীই বেশি!’ এটি স্রেফ ধারণা থেকে বলা। পরে গুগল সার্চ করে নিজের ধারণার সত্যতা মিলল। আসলেই আর্মেনিয়ায় নারীর সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগ বিশ্বের সকল দেশের জনসংখ্যার তথ্য প্রকাশ করেছে। একইসঙ্গে একটি দেশের মোট জনসংখ্যার নারী-পুরুষের অনুপাত প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নারী ও পুরুষ বসবাসকারী দেশগুলোর তালিকাও। জাতিসংঘের তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি পুরুষ ও নারী বসবাসকারী দেশগুলোর নাম প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নারী বসবাসকারী ১০ দেশের মধ্যে আর্মেনিয়ার অবস্থান ৭ম স্থানে। দেশটিতে প্রতি ১০০ জন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ১১৫.৬ জন।
তবে প্রায় সর্বত্র নারীর উপস্থিতি থাকলেও রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে তাদের অংশগ্রহণ কম মনে হয়েছে আমার। যেমন তিনদিন ইয়েরেভানে এরপর পর্যটন শহর সাখকাদজরে অনেক পুলিশ দেখলাম।পুলিশে কোন নারী সদস্য দেখিনি। কোন পাবলিক গাড়ির চালক নারী দেখিনি। কোন ব্যাংকেও নারী দেখতে পাইনি। তাহলে কি এখানেও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নারীর ব্যবহার বেশি?