রাত পোহাবে। ভোরের আলোও ফুটবে। তারপর যে রাতটির কাছে যাবে বাংলাদেশ, অনুভূতি-নিঃস্ব না হলে সকলকেই গভীর এক ক্ষতের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে ওই রাত। ১ জুলাই, ২০১৬; যে রাত ক্ষতি আর ক্ষতের পুরুত্ব বাড়িয়েছিল হলি আর্টিজান রেঁস্তোরায়। জঙ্গিবাদের চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে একদল পথভ্রষ্ট যুবক সেখানে দুঃস্বপ্নের সমাধি গড়ে তুলেছিল।
যার নিচে চাপা পড়তে পারত বাংলাদেশের বহির্বিশ্বগামী সবগুলো সড়ক-উড়াল পথ। একঘরে, বন্ধুশূন্য হয়ে যেতে পারত দেশ। সেটি যে হয়নি, তাতে দেশের মানুষের অদম্য ইচ্ছার সঙ্গে একদল বিদেশী বন্ধুর অবদানও অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের ওই জঙ্গি হামলা কাঁপিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। ঢাকার গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটিতে আটকে ছিল বিশ্বের চোখ। জঙ্গিরা সেখানে সেই রাতে দেশি-বিদেশী মিলিয়ে ২০ জনকে হত্যা করে। যাদের মধ্যে ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপানি, ৩ জন বাংলাদেশি এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। দুজন পুলিশও প্রাণ হারান। কমান্ডো অভিযানে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জন নিহত হয়।
রোমহর্ষক সেই ঘটনাকে ইসলামি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএস নিজেদের বলে দায় স্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক কোনও সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সম্পর্ক ছিল কিনা সেটি এখনো প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাক বা না থাক, আন্তর্জাতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
ওই ঘটনায় হুমকির মুখে পড়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনার ডিম দেয়া পোশাক খাত। এমনকি দাতা গোষ্ঠীরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিলে, অনিশ্চয়তার বেড়াজালে জড়িয়ে যেতে পারত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের চাকা।
পোশাক খাত তো আছেই, পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাণ ঝরেছিল সেই রাতে। ছয়জনই ছিলেন মেট্রোরেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বাধিক অগ্রাধিকারমূলক এই দুটি প্রকল্প থেকে বিদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নিলে বড় ক্ষতির মুখে পড়ত রাষ্ট্র ও সরকার। সঙ্গে এদেশে অন্যান্য খাতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিদেশি নাগরিকরা তো আছেনই।
রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়তো সেদিন আটকানো যায়নি, সেই ক্ষত আর ক্ষতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবারো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র আর নতুন করে ক্ষতি বাড়তেও দেয়নি। সেপথে দেশের সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের যেমন অবদান আছে; অপরিসীম অবদান আছে বিদেশী বন্ধুদেরও।
সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় স্বদিচ্ছা যেমন বেড়েছে, সাধারণ মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে। সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে জঙ্গিবাদ কেবল তো বাংলাদেশের বিষয় নয়। এটা এখন কুঁরে-কুঁরে খাচ্ছে গোটা বিশ্বকেই। এমন দুঃসময়ে বাংলাদেশকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের গুটিয়ে নেয়া কোনও বন্ধু রাষ্ট্রের সমীচীন সিদ্ধান্ত হতে পারে না। রাষ্ট্রগুলো তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়নি, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, পোশাক খাতকে বর্জন করেনি, উন্নয়ন কার্যক্রমে সহযোগিতা বজায় রেখেছে।
যার সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। মেট্রোরেল, পদ্মাসেতুর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। পোশাকখাত আছে স্বাভাবিক। অন্য যে মাধ্যমগুলোতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদেশিরা জড়িত, সেগুলোও মুখ থুবড়ে পড়েনি। হলি আর্টিজানের অপরিসীম ক্ষয়-ক্ষতির এপিটাফ লিখে তাই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ, অর্থনীতির চাকা।
সেদিন মুখ ফিরিয়ে না নেয়া রাষ্ট্র-নাগরিকদের সাহস-সহযোগিতার প্রভাব শুধু উন্নয়ন ও বাণিজ্যখাতেই পড়েছে তা নয়, দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রেও সেটি দৃশ্যমান। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল যেখানে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ সফর করেনি, সেখানে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল সিরিজ খেলে গেছে। ঘরোয়া লিগগুলোতেও খেলে যাচ্ছে বিদেশি ক্রীড়াবিদরা। বিদেশি কোচ, কোচিং স্টাফরা দায়িত্বে ফিরেছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন।
১ জুলাই এক বছর পুরতে যাচ্ছে হলি আর্টিজান দুঃস্মৃতির। যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের রাষ্ট্র ও পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কেবল করজোরে ক্ষমাই চাওয়া যেতে পারে। সেইসব নাগরিকদের পরিবার, দুঃসময়ে পাশে থাকা বন্ধু রাষ্ট্র ও তাদের কর্মমুখী মানুষদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞতা। হলি আর্টিজানের গভীর ক্ষতের ওপর সাহসের এপিটাফ লিখে চলা এই বন্ধুদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)