শিল্পের জন্ম কোন তারিখে হয়েছে বলা সম্ভব নয়, আমরা বলি হাজার হাজার বছর আগের গুহা চিত্রের কথা। কবিতা সংগীত নাচ কোন শিল্পেরই জন্মদিনটি জানা যায় না; কিন্তু আমরা জানি একটি নির্দিষ্ট দিনে সিনেমার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল, অর্থাৎ সিনেমার জন্মদিন আছে এবং সেটি হল ১৮৯৫-এর ২৮ ডিসেম্বর। পেরিয়ে গেছে ১২৬ বছর প্যারিসের স্যালুন ইন্দে দ্যু ক্যাফেতে অগাস্ত লুমিয়ের ও লুই লুমিয়েরের ১০ টি ৫০ সেকেন্ডের ধাবমান ইমেজ প্রদর্শনের মাধ্যমে সিনেমার জন্মের সময় থেকে।
সময় পেরিয়েছে অনেক, যার ডানায় ভর করে মানুষের বহুবিধ ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আদিম মানুষ ধূসর কোন অতীতে কোন একদিন হয়তো জলে তার প্রতিবিম্ব দেখেছিল—সেই ছিল মানুষের প্রথম আত্মোবলোকন, আয়না তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সেই থেকে মানুষের দুটো মৌলিক বাসনার জন্ম নিল; নিজেকে নিজে দেখা এবং পারিপার্শ্ব সহ ধাবমান সময়কে আঁটকে রাখা যা মানুষ সময় সাঁতরে সামনে গিয়ে অবলোকন করতে পারে। মানুষের এ দুটো বাসনা আসলে অবলোকনের বাসনা। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ এঁকেছে নিজেকে সে শিকার করছে, নাচছে, উপাসনা করছে দেবতার। সূর্যকে এঁকেছে। গুহায় দেখা যায় একটির পর একটি চিত্র, ধারাবাহিক ভাবে বিবৃত ঘটনা।
বিবৃত ঘটনা থেকে জন্ম নিয়েছে গল্প—যা ঘটেছে এবং যা কিছু কল্পনার। অর্থাৎ, মানুষের চোখের ও মনের অবলোকনকে মানুষ ন্যারেটিভে বর্ণনা করেছে; এভাবেই জন্ম শিল্পের, যা কিছু বিবৃত করলেও শেষ পর্যন্ত অদেখা এক জগতের উন্মোচন করে বিভিন্ন শৈলীর মাধ্যমে। অবলোকন ও তার ন্যারেটিভ নিয়ে শিল্পের গড়ন এবং এতেই শিল্পের সার ও প্রাণ।
সরাসরি আলোকচিত্র থেকে উদ্ভুত হলেও, সিনেমার ভিত্তিতে রয়েছে সমস্ত শিল্পকলার সমষ্টি। কিন্তু সিনেমা সব শিল্পের যোগফল নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি, ভিন্ন কিছু। সিনেমাই সবচেয়ে সার্থক অবলোকনের মাধ্যম, তাই এ মাধ্যম বা শিল্পটির নাম ‘সিনেমা’, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘দেখা’। সিনেমা শব্দটি এসেছে ইন্দোজার্মানিক Kino থেকে, উচ্চারণ সিনো, যার অর্থ গতির ধারণ, অর্থাৎ প্রবাহমান সময় ও ঘটনার সংরক্ষণ। সিনেমার অন্যান্য শব্দেও অবলোকনেরই প্রতিচ্ছায়া; যেমন Vitascope এবং Bioscope দুটো শব্দের মানেই জীবনকে দেখা। আরবিতে সিনেমাকে বলা হতো সুয়া মুতাহারিকা, যার অর্থ চলমান চিত্র, বাংলায় যেমন চলচ্চিত্র। সিনেমার হিব্রু শব্দ রেইনা-র অর্থ হচ্ছে নড়াচড়ার অবলোকন।
শুরুর অল্প কয়েক বছর সিনেমা শুধুই চোখের দেখা অবলোকিত ধাবমান সময়কে ধারণ করলেও অচিরেই সিনেমা মনের অন্তরালকে রূপ দিয়েছে রুপালি পর্দায়, আরও গভীরে গিয়ে মানুষের কল্পনার গভীর ও অবচেতনের তলকে উন্মোচন করেছে দেখার আধার ও আকার বদলে বদলে। সিনেমার জন্মের সময় ইউরোপে চিত্রকলা ও সাহিত্যে চলছে আধুনিক নিরীক্ষা সে সময়ের বৌদ্ধিক নয়া-জাগরণের সমান্তরালে, যা সংজ্ঞায়িত হয়েছিল ফ্রয়েডিয় অবচেতনের উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা থেকে। শিল্পে ইম্প্রেশেনিজম থেকে এক্সস্প্রেশেনিজম হয়ে দাদাবাদের জন্ম ও চর্চা, সাহিত্যে চলছে চেতন-প্রবাহ বা stream of consciousness-এর পরীক্ষা নিরীক্ষা। উত্তর ইউরোপের সিনেমা এ জাগরণ থেকে পিছিয়ে থাকলো না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দু দশক ফ্রান্স, ইতালি এবং কিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশে অদেখা অবলোকনের জগতকে উন্মোচন করতে গিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য বিমূর্ত সিনেমা। পরবর্তীতে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সিনেমাতে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়, এবং এখনও বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন সিনেমায় অতলের অবলোকন ফিরে ফিরে আসে।
অদেখার অবলোকন মূল ধারার হয়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ সিনেমার জনসম্পৃক্ততা এবং qualitative immediacy বা তাৎক্ষণিকতা। সিনেমাই সবচেয়ে শক্তিশালী জনসম্পৃক্ত শিল্প মাধ্যম, বাস্তবকে সিনেমায় বাস্তব হিসেবেই প্রত্যক্ষণ করা যায়—দর্শকের মনে হতেই পারে যা দেখানো হচ্ছে তা এ মুহূর্তে তাঁর চর্মচক্ষুর সামনেই ঘটছে। সিনেমা আমাদের শারীরিক ভাবে উদ্দীপ্ত করে, যা চিত্রকলা বা এমনকি আলোকচিত্রেও খুব একটা সম্ভব নয়। শরীর ও মন দুটোই সিনেমাক্রান্ত হয় বলে সিনেমার চাইতে শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম দ্বিতীয়টি নেই। ঠিক এ জায়গাটিতে এসেই সিনেমা একটি সাংঘর্ষিক অবস্থানে পৌঁছেছে—শিল্প ও বিনোদনের টানাটানি। জিতে গেলো বিনোদন, সিনেমা হয়ে উঠলো জীবনের সমান এবং একই সাথে জীবনের চাইতে বড় কারণ এখানে ঘটমান বাস্তবতাকে রংচঙে গ্ল্যামারাইজ্ড ন্যারেটিভে অবলোকনের জন্য দর্শকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়। তাই এ কোন চমক নয় যে থ্রিলার, অ্যাকশন, মেলোড্রামা এবং যৌন আবেদনের সিনেমা দর্শকধন্য হয়।
১২৬ বছরের পথপরিক্রমায় সিনেমা যুগের দাবি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপে এসেছিল হতাশার কালো ছায়া, আধুনিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষ জীবন ও অস্তিত্বের মানে নিয়ে সংকটে পড়ে। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আরও কিছু দেশে সমাজতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। একদিকে অস্তিত্বের সংকট এবং অন্য দিকে আদর্শের অনুসন্ধান; এ দুয়ের ফলশ্রুতিতে সিনেমায়ও তৈরি হয়েছে কিছু আন্দোলন—ইতালির নয়া বাস্তববাদ, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ, ফ্রান্সে নবতরঙ্গ ইত্যাদি। সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে হল ব্যাপক নিরীক্ষা; সিনেমা ভ্যারিতি, ডিরেক্ট সিনেমা ইত্যাদি আরও অনেক নতুন নতুন শৈলীতে সিনেমায় অবলোকনকে অর্থ দেয়া হল। বদলে যেতে থাকলো সিনেমার ভাষা। সিনেমাটোগ্রাফির ফ্রেমিং, সম্পাদনার গতি ও ধ্বনির ব্যবহার পাল্টেছে বিভিন্ন অভিমুখে।
সিনেমা নিয়ে ভাবিত বোদ্ধারা সিনেমাকে ব্যাখ্যা করলেন বিভিন্ন পটভূমি থেকে—উন্মেষ ঘটে সিনেমা তত্ত্বের। শুরুর দিনগুলোতে সিনেমার টেক্সটকে সিনেমার অর্থের নিয়ামক ভাবা হলেও ক্রমাগত সেখান থেকে সরে এসে এখন সিনেমাকে বোঝা হয় দর্শকের ব্যক্তিগত বোধের নিরিখে, অর্থাৎ ব্যক্তিক অবলোকন ও প্রত্যক্ষণই বর্তমান সিনেমা তত্ত্বের কেন্দ্র যেমন কগনেটিভ সিনেমা তত্ত্ব।
যে কথাটি বলা হয়নি তা হল সিনেমা শতাংশে প্রযুক্তি নির্ভর। সিনেমার কথনের বদল ও রূপান্তর সম্ভব হয়েছে ক্যামেরা, লেন্স, কৃত্রিম আলো এবং সম্পাদনা টুলসের ক্রমাগত বিবর্তন ও উন্নয়নে। বিগত দুই দশকে তথ্য প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়ন ও সীমানা-অতিক্রান্ত বিস্তারে বদলে গেছে সারা পৃথিবী, বদলেছে আমাদের জীবন ও জীবনাচার, এবং বদলে যাচ্ছে সিনেমা। কোটি টাকার ক্যামেরা আর তার চেয়েও বেশি দামের সম্পাদনা প্যানেলে নয়, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে সেল ফোনেই একটি সিনেমা তৈরি সম্ভব। পরিবেশক ও প্রদর্শকের কাছেও জিম্মি হয়ে থাকতে হয় না সিনেমার প্রদর্শনের জন্য, আছে বিবিধ ডিজিটাল প্লাটফর্ম সিনেমা প্রদর্শনের জন্য।
প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়ায় সিনেমা নির্মাণের ওপর আমজনতার যে প্রভুত্ব তাকে বলা যায় সিনেমার Domestication বা গার্হস্থ্যকরণ। সিনেমা এখন তৈরি থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটিই ঘরের হয়ে গেলো। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস গার্হস্থ্যকরণের ইতিহাস। আমরা ধান ও বিবিধ ফসলকে গার্হস্থিত করেছি, গরু ছাগল ও কুকুর ঘোড়াকে নিজেদের আয়ত্তে এনেছি। সিনেমার জন্মের ১০০ বছর পর নতুন সহস্রাব্দের আরম্ভেই শুরু হয় সিনেমার গার্হস্থ্যকরণ। নস্টালজিক হলে আমরা দেখবো হারিয়েছি অনেক কিছু, যেমন সিনেমা হল যেখানে অন্ধকারে বসে একটি জনসমগ্র একই সাথে রুপালি পর্দায় একটি জগৎ অবলোকন করতো। সেই দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই ফুরনোর ভেতর থেকে সুচিত হচ্ছে একটি নতুন অধ্যায়ের, মানব সভ্যতায় যা একেবারেই নতুন, প্রায় প্রতিটি মানুষই অচিরে বানাতে পারবে নিজস্ব সিনেমা আরও উন্নততর প্রযুক্তিতে, যদি সে চায়।
সবার সক্রিয় আংশগ্রহণে অবশ্যম্ভাবি ভাবে বদলাবে সিনেমার বিষয় এবং সর্বোপরি এর ভাষা। বদলে যাবে সিনেমার তত্ত্ব। বদলাবে আমাদের সিনেমা সেন্স এবং নান্দনিকতার বোধ। আরও বদলাবে অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের এতোদিনকার ভাব ও ভাবনা; বদলাবে একারণে যে মানুষ গার্হস্থিত সিনেমায় ব্যাপকতর আত্মোবলোকন এমন কিছু উন্মোচন করবে যা ছিল আমাদের ধারণার অতীত।