সল্ট লেক স্টেডিয়ামের মূল গেটে কিছুক্ষণ ফটোসেশন চললো তরুণ গবেষকদের! কি দারুণ পরিবেশ! এমন সুন্দর পরিবেশে দীর্ঘ জার্নির ধকলের কথা ভুলেই গিয়েছি আমরা। পাঁচ নাম্বার গেট দিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। গবেষণা সংসদের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসরিন জেবিন সুন্দর এই মুহুর্তটা ভিডিও করে রাখায় ব্যস্ত। সফর সঙ্গী আসাদুজ্জামান, সাদিয়া আফরোজা, জান্নাত, নভেরা, মনজুরুল, মেহেদী সবাই এসে হায়-হ্যালো করছে, খুনসুটি করছে।
আট দিনের ট্যুরে আমাদের আবাস হয়েছে সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ভেতরে ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ইয়ুথ হোস্টেল। এই হোস্টেলের দুটি ডরমেটরিতে উঠেছি আমরা। মূল গেট দিয়ে প্রবেশের সময়ই বুঝেছিলাম সল্ট লেক স্টেডিয়ামের পরিবেশ কি অসাধারণ! ভেতরে প্রবেশ করে দেখি আরো দুর্দান্ত। সুন্দর, গুছানো এবং পরিচ্ছন্ন। এমন দুর্দান্ত পরিবেশ কলকাতায় প্রত্যাশা করিনি। এই স্টেডিয়ামের হোস্টেলে দেশ-বিদেশের ক্রীড়াবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা এসে উঠেন। এখানে আমাদের ঠায় হওয়া একটু ব্যতিক্রম! তার মানে গবেষকরাও এখানে থাকতে পারেন। তরুণ গবেষকদের এমন একটি হোস্টেলে একসাথে রাখতে পেরে বেশ ভালো লাগছে আমার।
এর জন্য অধ্যাপক ড. বিশ্বনাথ চক্রবর্তী স্যারকেই শুরুতে ধন্যবাদ জানাতে হয়! রবীন্দ্র ভারতীর অধ্যাপক এবং বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের সাধারণ সম্পাদক তিনি। পশ্চিমবঙ্গে টিভি টকশোর পরিচিত মুখ। স্যারই যুব ভারতী মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে এই হোস্টেল ঠিক করেছেন। তাই আমাদের প্রথম ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা স্যারই পাবেন। আর কাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি? হ্যাঁ, মমতা দিদিকে। পশ্চিমবঙ্গে তো তিনিই একচ্ছত্র অধিপতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এটা অবশ্য আনুষ্ঠানিকতার ধন্যবাদ। দিলেও পারি, না দিলেও পারি।
এবার বিশ্রামের পালা। রাত হয়েছে। ১২টা বেজে গেছে। ইতোমধ্যে আমরা কেউ কেউ নিউমার্কেট এলাকার মারকুইজ স্ট্রিটস্থ নবাব রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসেছি। দারুণ একটি রেস্টুরেন্ট বলতে হয়। সকল ধরনের খাবার পাওয়া যায়। একেবারে বাঙালিয়ানা রান্না। গরুর মাংস বড় বাটি করে দিবে। মূল্য মাত্র ৪০ রূপি। সমপরিমাণ মাংস বাংলাদেশে ২০০ টাকার বেশি রাখবে। গরুর মাংস আমার প্রিয়! ভারত গিয়েও তা ভুলিনি! খেয়ে এসে ঘুমাতে যাচ্ছি। ঘুমানোর আগে সবাইকে জয়প্রকাশ দার সতর্কবাণী স্মরণ করিয়ে দিলাম আরেকবার। ভোর ৬টার মেদিনীপুরের বাস ধরতে হবে। কাজেই ভোরেই উঠতে হবে সবাইকে।
ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাই ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। দ্রুত প্রস্তুতি সেরে ৬টার বাসের জন্য বেরিয়ে পড়ি আমরা। সল্ট লেক স্টেডিয়ামের গেট থেকে করুণাময়ী স্টেশনে। অটো করে ১৫ মিনিটের পথ। ভাড়া পড়ে ১০ রূপি করে। এক অটোতে চারজন করে উঠে বসলাম। অটো দ্রুতই চললো। কিন্তু কাজ হলো না। ৫ মিনিট লেট! বাস ছেড়ে দিয়েছে ৬টার মধ্যেই। এক মিনিটও দেরি করেনি বাস। এই বাসটি ধরার খুব ইচ্ছা ছিলো আমাদের। তার জন্য বিকালে দুজনকে করুণমায়ীতে টিকেটের জন্যও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা নাকি অগ্রীম টিকেট দেয় না। স্পটে এসেই টিকেট নিয়ে বাসে উঠতে হয়।
কী আর করা! রাজ কুমার স্যারকে ফোন করে বাস মিস করার কথা জানালাম। স্যার পরের বাস কয়টায় জেনে নিতে বললেন। ৭টার একটি বাস আছে। কিন্তু বাসটি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে না। সেটা নিয়ে গেলে আমাদের ভুগান্তি বাড়বে। বিষয়টি স্যারকে জানালাম। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা ট্রেন ধরো। একটি এক্সপ্রেস ট্রেন আসে সাড়ে ৭টায়। সেটা ধরো। করুণাময়ী থেকে দ্রুত চলে যাও সালিমার রেল স্টেশনে…।
দ্রুত সালিমার স্টেশনে রওয়ানা দিই আমরা। হলুদ ট্যাক্সিক্যাবে উঠে বসেছি। সকালের পথ। মোটামুটি ফাঁকা সড়ক। সালিমার ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের বেশি লাগেনি। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দ্রুত টিকেট কাউন্টারের দিকে দৌঁড় দিই আমি। হাতে সময় আছে ২০ মিনিটের মতো। এর মধ্যে টিকেট কেটে সিট ধরতে হবে। এসব ট্রেনে সিট রির্জাভ করা যায় না। খালি থাকা সাপেক্ষে যার যেখানে মন চায় বসে যাওযা।
মেদিনীপুরের ভাড়া ৭৫ রূপি। প্রায় ১৮০ কিমি পথ। ১৯টি টিকেট কেটে ট্রেন ধরলাম আমরা। ট্রেন ফাঁকাই আছে। সবাই সিট পেয়েছি। যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়- একথা সত্য হলো মনে হচ্ছে। সকালে বাস মিস করে ভালোই হয়েছে। বাসে গেলে সময় বেশি লাগতো।ধকলও বেশি হতো। বাসে চড়লে জার্নির ধকল বুঝা যায়। কিন্তু ট্রেনে সেটা হয় না। ট্রেনে চড়ার মাঝে একধনের বন্য আনন্দ উপভোগ করি আমি। আর সেটা যদি হয় দল বেঁধে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে, কথাই নেই! মেদিনীপুরের যাত্রায় সেটাই হচ্ছে। আমরা ব্যাপক ফটোসেশন, আড্ডা, গল্প করতে করতেই চললাম আমাদের শৈশবের নায়ক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মস্থানের পথে…।
আধুনিক ভারতের প্রাণপুরুষদের মধ্যে অন্যতম বিদ্যাসাগর। বঙ্গীয় নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক। শিক্ষা, সমাজ সংস্কার করে তিনি অক্ষয় হয়ে আছেন। বিধবা বিবাহ প্রচলন করে এবং বহুবিবাহের বিরোধিতা করে নারী মুক্তি আন্দোলনেও অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন তিনি। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মডেল স্কুল স্থাপন, বর্ণবৈষম্য দূরিকরণ সহ আধুনিক বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতার জন্য যিনি অক্ষয় হয়ে আছেন। তার মধ্যে ছিলো ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রবল যুক্তিবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা,প্রগাঢ় মানবতাবাদ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দারুণ সমন্বয় ঘটেছিলো তার মধ্যে। যাকে নিয়ে মাইকেল মধুসুদন দত্ত লিখেছিলেন, যার মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মতো এবং হৃদয়বত্তা বাঙালি জননীর মতো’! হ্যাঁ তিনিই বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! যাকে পড়ে পড়ে আমরা বড় হয়েছি, যার কাছ থেকে আমরা শিখেছি উদারতা, বদন্যতা, সংস্কৃতি, সংস্কার! যে বিদ্যাসাগরের জ্ঞানের পরিধি জেনে জেনেই আমরা তার মতো হতে চেয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবার। আজ সেই বিদ্যাসাগরের জন্মভূমিতে যাচ্ছি; ভেতরে শিহরণ জেগেছে। ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছি এই কারণে যে, বিদ্যাসগারের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়েই আমাদের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সংলাপ’!
সবুজের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে বিদ্যাসাগরের পথে। পাহাড়, নদী, বন, সবুজ ক্ষেতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। অনাবিল আনন্দ ভার করে আমরা চলছি। বেশি আনন্দানুভূতি হলে আমার ঘুম চলে আসে। ঘুম ঘুম ভাব জমেছে চোখে। খানিক চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু এবার আমার ঘুম আসেনি, বিদ্যাসাগর এসেছেন! বিদ্যাসাগরের কথাই কল্পনা করছিলাম! ভাবছিলাম তার জন্ম, জন্মস্থান নিয়ে। কোথাকার মানুষ, কোথায় গেলেন, কী করে গেলেন! পৃথিবীতে ক’জন মানুষেই এভাবে সমাজ রাঙাতে পারেন? কতজনই বা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন? কিন্তু বিদ্যাসাগর সেটা পেরেছিলেন!
ভাবনার মাঝেই মেদিনীপুর স্টেশনের সিগন্যাল পড়েছে। ঠিক আড়াই ঘণ্টায় নির্ধারিত সময়েই আমাদের ট্রেন থামে স্টেশনে। হুড়মুড় করে সবাই নেমে পড়ি। আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। তার নেতৃত্বে আমরা টটো করে ক্যাম্পাসের দিকে রওয়ানা দেই। ৮-১০ মিনিটেই ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাই। বিদ্যাসাগরের প্রধান গেট দাঁড়িয়ে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে ফটোসেশনটা করতে ভুলিনি। এরপর গেটে সবার নাম স্বাক্ষর করে ভেতরে প্রবেশ করি। গেস্ট রুমে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। হালকা স্নাকস ও চা পান পর্ব চললো! কয়েক মিনিট পর ভেন্যুতে চলে গেলাম।
বিদ্যাসাগরের হলরুমে প্রবেশ করে চমকে যাই আমরা। প্রবেশ করতেই দেখি হল ভর্তি শিক্ষার্থী, স্কলারেরা দাঁড়িয়ে আমাদেরকে অভিবাদন জানালেন। শিক্ষকগণ এগিয়ে এলেন। রাজ কুমার কুঠারী স্যার এগিয়ে এলেন। গভীর স্নেহে তিনি বুকে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। রাজ কুমার স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই একটা গভীর আন্তরিকতা তৈরি হয়েছে। পিতৃসুলভ, বন্ধুর মতো এই সম্পর্ক অটুট থাকবে আজীবন!
হলরুমে আমাদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসেছি। এরপর সামনে তাকালাম। সুসজ্জিত মঞ্চ। মঞ্চের অতিথিদের নেমপ্লেট দেখে আমি চমকে যাই। প্রধান অতিথি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. রঞ্জন চক্রবর্তী স্যারের পাশে আমার নেমপ্লেট! এটি আমার জন্য বিব্রতকর! পশ্চিমবঙ্গে এসে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করা দু:সাহসের কাজ! আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের জন্য এটা যায় না!
আরো নার্ভাস হয়েছি যখন নেমেপ্লটে লেখা ‘শ্রী সাইফুল্লাহ সাদেক’ দেখলাম! রাজ কুমার স্যার এসে পাশে বসলেন। জানতে চাইলেন, তোমার নামের পাশে ‘শ্রী’ লেখা থাকায় কি কোনো আপত্তি আছে? কী বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম, না স্যার ঠিক আছে!
ভারতবর্ষে ‘শ্রী’ বসানো হয় বিশেষ মানুষকে সম্বোধন করতে, জনাব, মহাশয় ইত্যাদি অর্থে, ভক্তি, শ্রদ্ধা অর্থে! কিন্তু আমি কে? কী আমার পরিচয়? পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই তো নেই! তবু এমন সম্মান! এমন বিশেষণ আমাকে একটু বিচলিত করছে বটে! সুবোধ বালকের মতো বিব্রত, বিচলিত, নার্ভাস মন নিয়ে বসে আছি! এমন সময় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপাচার্য স্যার এসে পড়েছেন হলরুমে স্যারের সঙ্গে রাজ কুমার কুঠারী স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ রঞ্জন চক্রবর্তী স্যার। দেখলেই মনে হয়, সত্যি তিনি একজন উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক। তার সঙ্গে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিস্তর পার্থক্য মনে হলো। শুরুতেই আমি মুগ্ধ স্যারে!
অল্পক্ষণ পরই সম্প্রীতি সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হলো। ব্যতিক্রমী আঙ্গিকেই তা হলো! সাধারণত আমাদের এই অঞ্চলে প্রদীপ প্রজ্বলন করে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কিন্তু এখানে সূচনাটা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। চারা গাছে পানি দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। কারণ, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালালে কার্বণ নির্গমন হয়। কিন্তু ছোট্ট চারাগাছে পানি দিলে একটা নতুন জীবনের সূচনা হয়, যেটা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এমনই সুন্দর চিন্তা থেকে চারাগাছে পানি দিয়ে প্রোগ্রামের সূচনা হলো। মাননীয় উপাচার্য এবং আমরা কয়েকজন মিলে চারাগাছে পানি দিয়ে নতুন এক জীবনের সূচনা করলাম। এই গাছটি একদিন ছায়া দিবে, শান্তি ছড়াবে, বিদ্যাসাগরের মতো একটি বড় বৃক্ষে পরিণত হবে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি এমনিতেই পরিবেশবান্ধব, সবুজে সবুজে ভরপুর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, ভেতরে গভীর অরণ্য। কিন্তু এটি একটি বিদ্যার ঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, ঈশ্বরচন্দ্রের ক্যাম্পাস!
উপস্থাপক অতিথিদের মঞ্চে আহ্বান জানালেন। আমার স্থান হয়েছে রঞ্জন চক্রবর্তী স্যারের ঠিক পাশের চেয়ারে। এমন একজন মহান ইতিহাসববিদের পাশে বসতে পারা অনক বড় সৌভাগ্যের। স্যার খুবই আন্তরিক। সহজ-চিন্তা করেন।মহান ব্যক্তিত্ব।কথার মধ্যে একধরনের মাদকতা আছে। আগেই বলেছি, স্যারের ব্যক্তিত্বে আমি শুরুতেই মুগ্ধ হয়েছি!
পাশাপাশি বসাতে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। স্যারও আগ্রহী আমার সঙ্গে কথা বলতে। বাংলাদেশ এবং আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন। অল্প সময়ে নিজের পূর্ব পরিচয়টাও দিয়ে দিলেন। স্যারের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশেই। দেশবিভাগের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে। তাই বুকের মধ্যে লালন করেন বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ তার কাছে দুটি দেশ নয়, একটাই। একই ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ইতিহাস, যা আমাদেরকে কখনো পৃথক করার নয়।
তিনি নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। বিভিন্ন গবেষণা সম্মেলন ও শিক্ষা সম্মেলনে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। স্যারের হাতে আমার লেখা ‘আর্মেনিয়ার বাংলাদেশ’ বইটি তুলে দেওয়ার সুযোগ হলো। স্যার অনুপ্রাণিত করলেন দারুণভাবে!
এবার বক্তব্যের পালা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখলেন বিদ্যাসাগরের একজন অধ্যাপক। এরপর বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও অধ্যাপকরা বক্তব্য রাখলেন। এবার প্রধান অতিথির রঞ্জন চক্রবর্তী স্যার শুরু করলেন বাংলাদেশি অতিথিদের ভুয়সী প্রশংসা দিয়ে।আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন অভিবাদন।
তিনি বললেন, বাংলাদেশকে আলাদা চোখে দেখতে পারি না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে পৃথক করা যায় না। একই দেশ মনে হয়। আমার পূর্বপুরুষ এমনিতেই বাংলাদেশি। দেশটিকে নিজেরই মনে হয়। আমাদের সম্পর্ক, সম্প্রীতি সব সময় বিরাজমান। আমরা সম্প্রীতির ভেতর দিয়েই চলছি। আজকের সম্প্রীতি সংলাপ আমাদের সম্প্রীতিকে সুদৃঢ় করবে। বিদ্যাসাগরের এই ক্যাম্পাস তোমরা উপভোগ করবে, সম্প্রীতি, ভালোবাসায় মুগ্ধ হও’!
আমি মুগ্ধ হয়ে স্যারের বক্তব্য শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম আমি কী বলতে পারি সে কথা। বিদ্যাসাগরে এসেই যে মঞ্চে উঠে বক্তব্য দিতে হবে তা ভাবিনি। তাই কোনো প্রস্তুতিও ছিলো না। ভেবেছিলাম, নিজের অনুভূতিটাই হয়তো সংক্ষেপে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু এসে তো পড়লাম মুশকিলে! তবে দুয়েকটি শব্দ গুছিয়ে নিলাম। ‘নাচতে নেমে তো আর ঘোমটা দেওয়া যায় না!’
আমার পালা এলো। সাধারণ সম্বোধন দিয়েই শুরু করি বক্তব্য। নিজের, গবেষণা সংসদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করি সবাইকে। আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য রাজ কুমার কুঠারী স্যার এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। তারপর বললাম, ‘আমাদের সম্পর্ক, সম্প্রীতির সূত্র অনেক গভীরে। আমাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, আমাদের একই ভাষা, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধু, মহাত্মা গান্ধী, আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই আমাদের সম্পর্ক ও সম্প্রীতির সূত্র।
এই সম্পর্ক, সম্প্রীতি অবিচল থাকবে, যতোদিন পৃথিবী থাকব, বাংলা ভাষা থাকবে, সংস্কৃতি জীবন্ত থাকবে! যতোদিন মানব সভ্যতা থাকবে ততোদিন আমরা এক থাকবো, আমাদের মাঝে একটি কাটাঁতার আছে, সেটি গুঁড়িয়ে দিলেই আমরা এক, অভিন্ন…।
আমার বক্তব্যের পর ফটোসেশন চললো উপাচার্য স্যারের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন রাজ কুমার স্যার। লাল-সবুজ পতাকা হাতে আমরা ফটোসেশন করলাম। এরপর উপাচার্য স্যার প্রস্থান করলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ। এবার শুরু হলো দুই দেশের স্কলার ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘সম্প্রীতি সংলাপ’। শুরুটা হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে। দুটিই লিখেছেন কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা সসম্মানে দাঁড়িয়ে দুই দেশের জাতীয় সংগীত গাইলাম। এরপর আমাদের টিম থেকে বক্তব্য শুরু হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি নাসরিন জেবিন অসাধারণ বক্তব্য রাখলেন।দারুণভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করলেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক তানজিন আহসান, ইনোভেশন এন্ড ক্রিয়েটিভিটি বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুল হক মেহেদী। গবেষণা সংসদের প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ পরিচয় ও সংক্ষিপ্ত অনুভূতি ব্যক্ত করলো। তারপর বিদ্যাসাগরের স্কলার ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখলেন। তারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করলেন আমাদেরকে। নিজেদের আগ্রহ ও ভালোবাসার কথা শোনালেন। তারা ভ্রমণ করতে চায় বাংলাদেশে। আমরাও জানিয়েছি আমন্ত্রণ। দুই দেশের এই সম্প্রীতি, সম্পর্ক অবিচল থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করলাম সবাই।
কিছু সময়ের জন্য বিদ্যাসাগরের সবুজ ক্যাম্পাসে জয় বাংলার স্লোগান উঠেছিলো। এক হয়ে গিয়েছিলো বাংলা। আমরা আসলেই এক, অভিন্ন। আমরা জয় বাংলার সন্তান…।