রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর ‘সংগীত ও ভাব’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যে ভাষার ব্যাকরণ সম্পূর্ণ হইয়াছে, সে ভাষার পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে। ব্যাকরণে ভাষাকে বাঁচাইতে পারে না তো, প্রাচীন ইজিপ্টবাসীদের ন্যায় ভাষার একটি “মমি” তৈরি করে মাত্র।’-মূলত মমি যেমন জীবন্ত মানুষের আকার নিয়ে মৃত অবস্থায় থাকে যুগের পর যুগ ব্যাকরণও ভাষার চলমান প্রক্রিয়াকে রীতিনীতি দিয়ে বেঁধে রাখতে চায় একটা অবস্থানে। ব্যাকরণ ভাষাকে স্থির অবস্থায় বেঁধে রাখতে চায় বলেই এটিকে ভাষার মমি বলা যায়। জীব তার চলন বা বৃদ্ধি ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে জীবন্ত প্রমাণ করে। ভাষাও তার চলমান পরিবর্তনশীল পরিক্রমার মাধ্যমে নিজেকে জীবন্ত হিসেবেই প্রকাশ করে।
ব্যাকরণ ভাষার পরিবর্তনসমূহে বাধাদান করে। তারপরও কঠিন শাস্ত্রের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করে ভাষা উন্নততর অবস্থানে উঠে আসে। ফলে ব্যাকরণ ভাষার সমস্ত বিষয়কে ব্যাখ্যায় আনতে পারে না যেগুলো ব্যতিক্রম হিসেবে আমাদের সামনে আসে।
সংগীত শিল্পের উপর শাস্ত্রীয় রীতিনীতির কঠোরতায় যখন শিল্প হারায় সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উপরোল্লিখিত মন্তব্যটি করেছিলেন। কিন্তু মন্তব্যটি সিংহভাগ সংগীত শিক্ষকের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। মৃত ভাষার মতো এই শিক্ষকরাও নিজের মস্তিষ্কে ও পান্ডুলিপি আকারে খাতায় কিছু স্বর অভ্যাসের নিয়ম এবং সংগীত শিক্ষাদানের কিছু নিয়মকে মমি করে নিজে মৃত ওস্তাদ হিসেবে স্থির হয়েছেন। বাঙালির সংগীত চর্চার ইতিহাস স্বল্প সময়ের নয়। এই সংগীত চর্চার ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে অগণিত শিক্ষার্থী। তৎকালীন ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে সংগীত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বৃহৎ বাংলায় মূলত পরম্পরা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে শুধুমাত্র বিষ্ণুপুর সংগীত ঘরাণা। তবে বাংলার আনাচে কানাচে সব জায়গাতেই চলে সংগীতের শিক্ষাদান ও চর্চা। এই সংগীত শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী যুক্ত হলেও ঝরে যায় প্রায় সবাই। নানা কারণে সংগীত শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হলেও বড় একটা অংশ সংগীত বিমুখ হয় কণ্ঠ সংগীত প্রকাশের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ায়। যেখানে সুমিষ্ট কণ্ঠ এবং প্রাকৃতিক সংগীত প্রতিভা নিয়ে শিক্ষার্থীরা সংগীতে তালিম নিতে আসে সেখানে তাদের সংগীতে উন্নতির বদলে তারা যোগ্যতা হারায় গাওয়ার। পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, যারা ঈশ্বর প্রদত্ত সংগীত প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি তারাও চর্চার মাধ্যমে সংগীতে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরাও হারিয়ে যায় কণ্ঠের সমস্যা বা প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ার কারণে।
পারিবারিক সংগীত ঐতিহ্য নিয়ে খুব কম ছেলেমেয়েই সংগীত শিক্ষা শুরু করে। পরিবেশ থেকে যাদের অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ হয় না তারা একমাত্র গুরুর উপরেই নির্ভর করে। সংগীতের অধিকার যতটুকু শিক্ষার্থীরা পায় সেটুকু গুরুর মুখ থেকে শুনেই। এজন্যই এটি গুরুমুখী বিদ্যা। কিন্তু গুরুর সংগীতজ্ঞান এবং সংগীত বিষয়ে মনন কতটুকু সমৃদ্ধ তা বিবেচনার দাবি রাখে। ভালো গান গাইতে পারা মানেই ভালো শিক্ষক নয়। মনে রাখতে হবে, ব্যাকরণবিদ আর কবির মধ্যে যে পার্থক্য সংগীতশিল্পী এবং সংগীতের শিক্ষকের মধ্যে একই পার্থক্য। একটি পাখিকে যেমন সাধনার মাধ্যমে মানুষের মতো কথা বলা শেখাতে হয় তেমনি একজন কথা বলতে পারা মানুষকেও সাধনার মাধ্যমে শিল্পী বানাতে হয়। এ সাধনা গুরু হয়ে ওঠার সাধনা। প্রতিটি মানুষের আচার, খাদ্যাভাস, রুচি, শারীরিক গঠন, কথা বলার ধরন, কণ্ঠের প্রকৃতি, উপলব্ধি করার ক্ষমতা, শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ইত্যাদি ভিন্ন। সুতরাং শিক্ষক যে পথে শিক্ষা গ্রহণ করে তার শিক্ষা গ্রহণের পথ নিজের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। গুরু প্রদর্শিত একটি পথে নিজে সংগীতে বুৎপত্তি অর্জন করলেও শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুকে সৃষ্টি করতে হয় শত রকমের পথ এবং কার জন্য কোনটা উপযুক্ত সেটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা শিক্ষকের অবশ্যই থাকা জরুরি।
প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিল্পী তৈরি করতে হলে প্রত্যেকের উপর স্বতন্ত্র গবেষণা প্রয়োজন একজন গুরুর। প্রচলিত শিক্ষার পথ এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে একজন শিক্ষার্থী যেটুকু শিক্ষা অর্জন করতে পারে সেটুকুতেই সে সীমাবদ্ধ থাকলে সংগীত তার পরিবর্তিত রূপ গ্রহণ করতে পারতো না। বৈদিক যুগের সংগীত আজকের অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে প্রতি প্রজন্মেই নতুন কিছু সংযোজন করার ইতিহাস। সত্যিকার অর্থেই গুরু হতে হলে অবশ্যই সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে হবে। গুরু যেটুকু দেন তার অর্জিত হাজার বছরের সংগীত ধারার জ্ঞান সেই শিক্ষা সমাপ্ত করে শিষ্যদের পথ চলা শুরু হয় তারা লব্ধ জ্ঞানকে উন্নততর অবস্থানে নিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হতে না পারলে সংগীতের গুরু হয়ে তার শিষ্যদের তিনি কোনো পথই দেখাতে পারবেন না। সামগ্রিকভাবে একজন সাধারণ মানুষকে শিল্পী হিসেবে তৈরি করার জন্য শিক্ষককেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা রাখতে হয়।
এখন সময়ের প্রয়োজনেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগছে শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সংগীতও তার বিপরীত নয়। স্বর প্রক্ষেপণ, সুর উৎসরণ, কম্পন উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ, শব্দের তীব্রতা, শব্দ যন্ত্রের মাধমে উপযুক্ত শিল্প সম্মত শব্দ উৎপাদন ইত্যাদি সব বিষয়েই বিজ্ঞান উপযুক্তভাবে কাজ করছে। সংগীতের পথে সহযোগী হিসেবে বিজ্ঞানকে সঙ্গী করার দায়িত্ব গুরুর। তিনি সঠিক পদ্ধতিতে তার শিষ্যদের তৈরি করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অনিয়ন্ত্রিত শব্দ উৎপাদন এবং সংগীতে তা ব্যবহারের জন্য গুরুই নির্দেশনা দেন শিষ্যদের। ফলে কণ্ঠস্বরে যে চাপ পড়ে তা শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। নিজস্ব শিক্ষণ পদ্ধতি এবং নিজের খাতা বা আদর্শ হিসেবে রক্ষিত কোন বইয়ের স্বর অভ্যাসের উপকরণ এমনকি নিজের গাওয়ার স্কেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে সংগীত শিক্ষায় সহযোগিতার বদলে যারা পদ্ধতিগতভাবে বিদ্যার্থীদের নির্যাতন করে সংগীত শিক্ষার মৃত্যু ঘটান তারাই মূলত মৃত ওস্তাদ। নিজে জীবিত হয়ে শিষ্যদের কণ্ঠে সুর জীবন্ত করে তোলাই তো প্রকৃতপক্ষে গুরুর কাজ।
সর্বোপরি সঙ্গীত একটি কঠিন অথচ মানব সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্প। এ শিল্পের দায়িত্ব কিছু অকেজো মানুষের উপর দিয়ে সমাজে এ শিল্পকে অকেজো করে রেখে দিলে আমরা সভ্যতার মরুভূমি গড়ে তুলবো। যত্নশীল হয়ে যেমন শিক্ষা দেওয়া জরুরি তেমন জরুরি যত্নবান হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা। উপযুক্ত গুরু সন্ধান করে তার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করা বাধ্যতামূলক। পাখি যেমন খাবার গ্রহণ করে হজম করা খাবার বাচ্চাকে খাওয়ায় সঙ্গীত গুরুও সুর নিজে প্রথমে নিজের ভেতর পরিপাক করেন এবং পরে সেটা তুলে দেন শিক্ষার্থীদের মুখে। সুতরাং আত্মা থেকে আত্মায় আবেগ, অনুভূতি এবং উপলব্ধি মেশানো যে যোগাযোগ ঘটে গুরু শিষ্যের মধ্যে সেটিকে মহামূল্যবান ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়।
লেখক: মো.মামুনুল ইসলাম অধ্যক্ষ, শিশুতীর্থ আনন্দধ্বনি সংগীত বিদ্যায়তন ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ