বইমেলা বিষয়ে কোনো আলোচনা করার পূর্বে এদেশে বইমেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্নণা করা প্রয়োজন। ‘মেলা’র সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। তাই স্বাভাবিক ভাবে ইংরেজি ‘ফেয়ার’ শব্দের বাংলা অতি সহজে ‘মেলা’ করে ফেলেছি। আমাদের বাংলাদেশে যে মেলার সঙ্গে আমরা পরিচিত সেই মেলাতে কোনোদিন বই ছিল না। বইয়ের সঙ্গে মেলা শব্দটি সম্ভবত খাপ খায় না। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে মেলার চরিত্র এবং বইয়ের চরিত্র ভিন্ন। তবুও যে প্রকারেই হোক্ কেনো কোনো উপলক্ষ্যে বিশেষ কোনো এলাকায় সাময়িকভাবে বই বিক্রির ব্যবস্থাকে আমরা ‘বইমেলা’ বলে থাকি। ১৯৬৪ অথবা ১৯৬৫ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে ‘শিশু গ্রন্থমেলা’র আয়োজন করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচের তলায়। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। সেটি ছিল প্রথম বইমেলা। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি ২১শে ফেব্রুয়ারির সময় একাডেমির বই অর্ধেক মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। এরপর প্রতিবছর ২১শে ফেব্রয়ারির সময় অর্ধেক মূল্যে বই বিক্রি হতো। কম মূল্যে বই কেনার জন্য অনেকে অপেক্ষা করতেন এবং এ সময় বেশ ভিড় হতে আরম্ভ করেছিল। একদিকে বটগাছের তলায় চলতো বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর ভবনের নিচের তলায় বারান্দায় বই বিক্রি চলতো। সেটাই ছিল ২১শের বইমেলার শুরু। তবে ‘বইমেলা’ নাম দিয়ে বইমেলার প্রথম আয়োজন হয়েছিল ১৯৭০ সালে সূধীজন পাঠাগারের উদ্যোগে নারায়নগঞ্জ ক্লাব প্রাঙ্গণে।
ঢাকা তথা বাংলাদেশে নিয়মিত ‘বইমেলা’ বা ‘গ্রন্থমেলা’র প্রচলন হয়েছে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সাল থেকে। কখনো নাম ছিল ‘গ্রন্থমেলা’, কখনো ‘একুশের বইমেলা’ আবার কখনো ‘জাতীয় গ্রন্থমেলা’। ‘একুশের বইমেলা’ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ক্ষুদ্র হতে বৃহৎ ও বৃহত্তর হয়ে বর্তমানে বিশাল ‘মেলায়’ বা ‘আড়ং’-এ পরিণত হয়েছে। অপর দিকে ঢাকার বাইরে বইকে প্রচারিত করার নিয়তে যে ‘জাতীয় গ্রন্থমেলা’র ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল তাকে বাদ দিয়ে রাজধানী শহরে ‘ঢাকা বইমেলা’ নামে দ্বিতীয় একটি পরিচ্ছন্ন বইমেলা চালু হয়ে কয়েক বছর যাবত চলছে। এই মেলা প্রথমে জানুয়ারি মাসের শুরুতে আরম্ভ হতো, এখন ডিসেম্বরে হচ্ছে। সংক্ষেপে এটাই বইমেলার ইতিহাস। এই ইতিহাস প্রায় সকলেই জানেন, তবে মনে হয় মনে রাখতে পারেন না। মোটকথা দীর্ঘদিন যাবত আমরা ‘বইমেলা’ বা ‘গ্রন্থমেলা’ উপভোগ করে আসছি এবং এর বয়স প্রায় স্বাধীন বাংলাদেশের সমান। এখন সম্ভবত সময় হয়েছে বইমেলার কার্যকারিতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। এর মূল্যায়ন করার।
বইমেলার উদ্দেশ্য ছিল বইকে প্রচারিত করা, জনপ্রিয় করা, বইয়ের বিক্রয় বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। কিছুটা চিন্তা-ভাবনা না করেই বইমেলা বা গ্রন্থমেলা আমরা চালু করেছিলাম বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র হতে। এর পেছনে একটা স্বতস্ফূর্ততাও কাজ করেছিল, যেমন দু-একজন প্রকাশক ব্যবসায়িক বুদ্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন কিছু বই নিয়ে একাডেমির গেটের নিকট বসতে আরম্ভ করে। একুশে ফেব্রুয়রি যে ‘জাতীয় শোক দিবস’ সে কথা বিস্মৃত হয়ে গণজমায়েতকে পুঁজি করে তারা ব্যবসা শুরু করলেন। অন্যদিকে, ভবিষ্যত চিন্তাভাবনা না করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আমরা মেলা জমতে দিলাম। এবং সেভাবেই ক্রমান্বয়ে ২১শের বইমেলা ব্যাপকতা লাভ করেছিল। মূলত: এ দায়িত্ব ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এবং তারাই প্রথম ১৯৬৪ সালে ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ এবং ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে চিন্তা-ভাবনা করেই একাডেমি প্রাঙ্গণে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিল।
এরপর জাতীয় গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হতো ঢাকার বাইরে, একেক বছর একেক জেলা শহরে। এসব মেলা যে বাংলাবাজারের ক্ষুদ্র সংস্করণ হতে যাচেছ তা আমরা তখন কেউই অনুধাবন করতে পারিনি।‘কলকাতা বইমেলা’ এবং বাংলাদেশের ‘ঢাকা বইমেলা’ ও ‘একুশের বইমেলা’ অনেকটা এক রকম। অন্যদিকে, বিশ্বের অপর সকল উন্নত দেশের বইমেলা ভিন্ন প্রকারের। এমনকি দিল্লির ওয়ার্লড বুক ফেয়ারও ভিন্ন প্রকৃতির। ভাবতে অবাক লাগে উন্নত বিশ্বের তাবত বইমেলা এক ধরনের আর বাঙালির বইমেলা ভিন্ন ধরনের। এটা কি বাঙালি চরিত্রের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে? অথচ উন্নত দেশের বইমেলা অনুসরণ করেই আমরা এই অঞ্চলে বইমেলার আয়োজন করেছিলাম। বক্তব্যটি শুনতে পরস্পর বিরোধী মনে হতে পারে। বলছি উন্নত বিশ্বের অনুসরণে বইমেলার সূত্রপাত, অথচ তাদের মেলার মতো আমাদের এই বইমেলা নয়। সবচেয়ে বড় পার্থক্য- তাদের বইমেলা খুচরা বই বিক্রির জন্য নয়। আমাদের বইমেলা মূলত খুচরা বই বিক্রির জন্য। উন্নত বিশ্বের বইমেলা প্রধানত প্রচার, বিপণন ও বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়। খুচরা বিক্রি হয় খুব সামান্য। আমাদের বইমেলা প্রধানত খুচরা বই বিক্রির উদ্দেশ্যে আয়েজন করা হয়। এই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। দ্বিতীয় পার্থক্য, সকল বইমেলায় প্রবেশ করতে হলে প্রবেশ-মূল্য দিতে হয়। আমাদের বইমেলায় কোনো প্রবেশ-মূল্য দিতে হতো না।
১৯৯১ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সর্বপ্রথম প্রবেশ-মূল্য প্রবর্তন করে যা অদ্যাবধি চালু আছে। নামমাত্র প্রবেশ-মূল্য ধার্য করলে জানা যায় মেলায় কতজন দর্শক মেলা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু এখানে তা হবার নয়। প্রকৃত তথ্য না থাকার কারণে মনগড়া তথ্য অতি সহজে পেশ করা যায়। অযৌক্তিকভাবে প্রবেশ-মূল্য ধার্য না করার পেছনে যে মানসিকতা কাজ করে তা আমরা অনুমান করতে পারি।
ঢাকা শহরে প্রতিবছর দুটি বড় বইমেলা অনুষ্ঠিত হবার পর গ্রন্থজগতের কতখানি উন্নতি হয়েছে তা জানতে ইচ্ছা করে। সংবাদপত্র পাঠ করে একপ্রকার ধারণা জন্মে, অন্যদিকে সাধারণ লেখক হিসেবে অভিজ্ঞতা হয় ভিন্ন প্রকৃতির। লেখক মনে করেন প্রচুর বই বিক্রি করেও প্রকাশক তার প্রাপ্য রয়ালটি দেন না। বর্তমানে প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক লেখক বই লিখছেন। কবির সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু মাত্র দু-একজন জনপ্রিয় লেখকের বই প্রচুর বিক্রি হয়। তাছাড়া ননফিকশন তথ্যপূর্ণ বই বিক্রি হয় খুবই কম। সবচেয়ে মারাত্মক ত্রুটি- এসব বই সম্পর্কিত তথ্যের অভাব। কেবল একজন লেখকই বলতে পারেন তাঁর বই কী পরিমান বিক্রি হয়। কী পরিমান রয়্যালটি তিনি পেয়ে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি এমনই স্পর্শকাতর যে তিনি এ বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন। অধিকাংশ বই যে লেখকের অর্থে প্রকাশিত হয় একথা অনেকেই জানেন না।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বই যে মফস্বল শহরে পাওয়া যায় না। এমনকি ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইয়ের দোকানেও পাওয়া যায় না, একথাও সত্য। কোনো একটি বইয়ের খবর পেয়ে বা রিভিউ পাঠ করে যদি কিনতে ইচ্ছা করে তাহলে আমাকে সেই বইয়ের প্রকাশকের বাংলাবাজারের দোকানে যেত হবে অথবা পরবর্তী ‘ঢাকা বইমেলা’ বা বাংলা একাডেমির ‘একুশের বইমেলা’ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তিরিশ/ চল্লিশ বছর আগে এদেশে সাধারণ প্রকাশনার যে অবস্থা ছিল, আজও প্রায় সেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। গুণগত পরিবর্তন হয়নি, পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। আগে প্রকাশকের সংখ্যা ছিল কম, এখন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। লেখকের সংখ্যা কম ছিল, এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্বে মাসুদ রানা বাইরের বইয়ের দোকানে পাওয়া যেত, এখন সেই সঙ্গে আর দু-একজন যুক্ত হয়েছেন। মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
বইমেলা বড় হয়েছে তবে বইয়ের বাজার ছোট হয়েছে। প্রকৃত পাঠক ও ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয় না। জনসংখ্যা যেহেতু বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু প্রকাশনার সংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বিবেচনায় ঢাকা বইমেলা বা একুশের বইমেলা আমাদের প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করেছে বলা ঠিক হবে না। স্বৈরাচারি সরকারের আমলে বছর বছর বইমেলার বিবর্তন হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থমেলা সূচনা হয়েছে রাজধানীতে, পরে পর্যায়ক্রমে গিয়েছে বিভাগীয় ও জেলাশহরে। মফস্বল শহরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ স্থাপিত হতো তখন। ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থমেলা গিয়েছে গ্রামে-গঞ্জে। সেগুলোর পেছনে একটা যুক্তি ছিল: স্থানীয় বই বিক্রেতারা যাতে সৃষ্টিশীল গ্রন্থের বাণিজ্যিক মূল্য অনুধাবন করতে পারেন। সেই মেলাগুলো বন্ধ করে বই বিক্রেতাকে বইমেলার সঙ্গে যে সামান্য সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল তাও রহিত করা হলো।
বইয়ের বাজার প্রসারিত হচ্ছে বলা চলে না। বরং সঙ্কুচিত হয়েছে। নিকটবর্তী কোনো বইয়ের দোকানে যদি বইটি পাওয়া না যায়; কেবল ঢাকার বইমেলায় প্রকাশকের স্টলে বইটি পাওয়া যায় তাহলে বইয়ের বাজার সঙ্কুচিত হলো না? কোনো প্রকাশকের যদি কয়েক’শ চেইন বুকশপ থাকতো তাহলে কিছুটা আশা করা যেত। অথবা কোনো প্রকাশক নিজে খুচরা বই বিক্রি না করে কয়েক’শ বইয়ের দোকানের মাধ্যমে তার বই বিক্রি করতে পারতেন তাহলে বাজার প্রসারিত হতো। যেহেতু প্রকাশক নিজেই খুচরা বই বিক্রি করেন সেহেতু বইয়ের দোকান আর তার বই বিক্রি করেন না। তবে কোনো লেখকের বইয়ের চাহিদা যদি কোনো কারণে একবার সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে আর সমস্যা নাই। মফস্বলের বইয়ের দোকানি তার বই সংগ্রহ করতে ঢাকায় ছুটে আসবে।
অথচ উন্নত বিশ্বের বইমেলা খুচরা বই বিক্রি না করেও কেবল বই প্রদর্শন করে পাইকারদের আকৃষ্ট করে এবং বিপুল অর্ডার লাভ করে। সেখানে বই কেনার জন্য বইমেলার অপেক্ষা করতে হয় না। যারা বই কিনেন, বই পড়েন তারা যখনই নতুন একটি পছন্দসই বইয়ের সংবাদ পান তিনি ছুটে যান নিকটস্থ বইয়ের দোকানে। দ্রুত না গেলে বইটি সহজে আর পাবেন না। এর বড় কারণ বোধ হয় এই যে, উন্নত বিশ্ব পড়ুয়া জাতি। উন্নত বিশ্বের মানুষ বইপড়াকে নিত্যদিনের ক্রিয়া মনে করে। তারা মনে করে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যেমন প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যকে রক্ষার জন্য নিয়মিত বই পড়তে হয়। তারা পথে যেতে যেতে ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, পাতাল ট্রেনে বই পড়ে। বই পড়ার জন্য তাদেরক আলাদা সময় খুঁজতে হয় না। তাদের সময়ের আরও অভাব। সপ্তাহের পাঁচটি দিন যে কোন্ দিক দিয়ে কেটে যায় তা তারা বুঝতে পারে না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আরও সময় পাওয়া যায় না। তবু তারা বই পড়ে।
অপরপক্ষে বাঙালিরা কি অপড়ুয়া জাতি? আমরা কি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা বা তার পরিচর্যার কথা চিন্তা করি? না, করি না। সে কারণে আমাদের বইপড়া যেন বছরে একদিন। বই কেনাও বছরে একদিন। আমাদের বই পড়া মানসিক-স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য নয়। আমাদের প্রকাশকরা বোধ হয় এমনভাবেই আমাদের মূল্যায়ন করেন। তারা মনে করেন আমাদের বই পড়া নিছক বিলাসিতা, বিনোদন ও উচ্চবিত্তকে অনুসরণ। সেজন্য তারা আমাদের বইকে আমাদের হাতের নাগালে পৌঁছে দেবার কোনো চেষ্টা করেন না। যদি তা করতেন তাহলে নিজেরা খুচরা বই বিক্রি করতেন না। বইয়ের দোকানকে উদ্বুদ্ধ করতেন তাদের বই বিক্রি করতে। বই মানে এখানে বাংলা বইয়ের কথাই বলা হচ্ছে। উচ্চবিত্তের নতুন শ্রেণি এখন প্রধানত ইংরেজি বই পড়েন। তাদের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে আর বাংলা বই পড়ে না। তারপরও বাংলাদেশে এত প্রকাশক এতো বই প্রকাশ করেন! বেশ আশ্চর্যের বিষয়! এত বই কারা পাঠ করেন? প্রকৃতপক্ষে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা বই ক্রয় করেন। এবং বইগুলো প্রধানত অতি যত্নে আলমারিতে তালাবন্ধ থাকে। বই ক্রয়ের জন্য সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলে প্রকাশকদের ব্যবসা ভালো হয়। বরাদ্দ হ্রাস পেলে তাদের বড় দুঃখ হয়। কারণ তারা তো জনসাধারণের বই ক্রয়ের ওপর নির্ভর করেন না! অবশ্য হাতেগোনা কয়েকজন প্রকাশক ও লেখক বাদ দিয়ে।
আমাদের প্রকাশকগণ মূলত পাঠ্যপুস্তক ও নোটবুক প্রকাশক। সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য তাদের অনেকে কিছু সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে অধিকাংশ পুস্তকবিক্রেতা পাঠ্যপুস্তক ও নোটবুক বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশকগণ পুস্তক বিক্রেতার ওপর নির্ভরশীল হতে পারেন না এবং মেলায় নিজেরা বই বিক্রি করে কিছুটা পুশিয়ে নিতে চেষ্ট করেন। এই পদ্ধতি বই বাজারজাত করার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি বলে স্বীকৃত নয়। তবুও পাঠ্যপুস্তকের নিয়ন্ত্রিত বাজারে তদবিরের মাধ্যমে মুনাফা করার অভ্যাস ত্যাগ করে খোলাবাজারে প্রতিযোগিতায় নামা খুব কম প্রকাশকের সাহসে কুলায়। তাই তাদের চেষ্টা থাকে অল্পকিছু বই পরীক্ষামূলকভাবে প্রকাশ করা যাতে সব কপি অল্প সময়ে শেষ হয়। সেজন্য তো রয়েছেই দেশের ৬৪টি জেলায় ৬৪টি সরকারি গণগ্রন্থাগার, অজস্র বেসরকারি গণগ্রন্থাগার, স্কুল কলেজের গ্রন্থাগার, বিভিন্ন প্র্রতিষ্ঠানে পুরস্কার হিসাবে বই ক্রয় ইত্যাদি এবং অবশিষ্ট কিছু বইমেলায় বিক্রি হলেই তারা তৃপ্ত। এর বড় কারণ জনসংখ্যার দিক হতে আমাদের এই দেশটা বিশাল। সেই বিশাল জনসমুদ্রের মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যদি বছরের একদিন একটি বই ক্রয় করেন তাহলেও তার পরিমাণ একজন ক্ষুদ্র প্রকাশকের জন্য অনেক। তাই তারা বোধ হয় চেষ্টা করেন যাতে সরকার তাদের কিছু বই ক্রয় করে।
তাদের এই চেষ্টা সফল হয়েছিল বিগত দুই সরকারের আমলে। তখন তারা এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, ফলে পাঠক তার পছন্দ বা চাহিদা মতো বই পাননি। পাঠকের ওপর বাছাই করা বই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে বইগুলো বিভিন্ন গণগ্রন্থাগারে পরে আছে। খুব কম পাঠক সেসব বই পাঠ করেছেন। কিন্তু এমন ব্যবস্থতাই তো এই প্রকাশকদের জন্য কাম্য! বই পড়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বই বিক্রি হওয়া। এমনই তাদের মানসিকতা। বইমেলার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অথবা এর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আপাত দৃষ্টিতে অন্য প্রসঙ্গ এসে পড়েছে; যদিও বিষয়গুলো একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয় দেশে পাঠ্যপুস্তক শিক্ষা-ব্যবস্থার একটি বড় অংশ। তাদের জগত ভিন্ন।
সেখানে যেমন পাণ্ডিত্বের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা। সেখানে যারা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কারবার করেন তাদের জগত আলাদা। তারা সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশ করে জনসাধারণকে ধোঁকা দিতেন না। অন্যদিকে আমরা যাকে আউট বই বা সৃষ্টিশীল গ্রন্থ বলি তার প্রকাশনার জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা, মেধা ও সৃষ্টির আনন্দ। সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশে নিছক মুনাফা অর্জনের আনন্দ নয়, এই আনন্দ সৃষ্টির আনন্দ। লেখকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার আনন্দ। সে কারণে উন্নত দেশে সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশকগণ মনে-প্রাণে সৃষ্টিশীল। তারা বছরে এক দিন বই প্রকাশ করেন না। তারা সারাবছর বই প্রকাশ করেন। তাদের বই প্রকাশের মৌসুম নেই। তাদের একটি নতুন বই প্রকাশ হলে তার এমন প্রচারণা, এমন বিপণন, এমনভাবে মার্কেটিং করেন যেন মনে হয় তার মাত্র একটি বইই এ জীবনে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তখন সারা দুনিয়ার সকল বইয়ের দোকানি উদগ্রীব হয়ে সেই বইটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের মেলায় তাই প্রদর্শিত হয় আগামি বছরে যেসব বই প্রকাশিত হবে সেসব বই অথবা গত এক বছরে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে সেসব বই। মেলার জন্য, কেবল মেলার সময় বই প্রকাশিত হয় না। তাদের বই হয়তো প্রতিমাসে অথবা প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। কেবল মেলায় বিক্রি হবে এমন ক্ষুদ্র পরিকল্পনা তারা করেন না। বই প্রকাশ হবার অনেক আগে হতেই তার বিপণন পরিকল্পনা হতে থাকে। যেমন :কানাডার টরেন্টো শহরের একটি বইয়ের দোকানে ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তণ প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন তার নতুন বইয়ের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। কয়েকদিন থেকেই কাগজে সংবাদ ছিল তিনি আসবেন, আর যারা বই কিনবে তাদের বইয়ে তিনি স্বাক্ষর করবেন। যারা তার ফ্যান তারা আগে হতেই দোকানের সামনে ফুটপাথের উপর লাইন ধরে বসেছিলেন। আগের দিন বিকেল হতেই তারা লাইন ধরেছিলেন। এই বইয়ের দোকানের নাম ’ওয়ার্লডস বিগেস্ট বুকশপ’ এখানে প্রায় প্রতিবছর কোনো একজন নামকরা ব্যক্তি তার বইয়ে স্বাক্ষর দান করেন।
২০০৩ সালে কনার্ড ব্ল্যাক তার লেখা রুজভেল্টের জীবনী এখানে স্বাক্ষর দান করেছিলেন। ২০০২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র-অভিনেতা কার্ক ডগলাস তার আত্মজীবনী ‘মাই স্ট্রোক অব লাক’ গ্রন্থে এখানে বসেই স্বাক্ষর প্রদান করেন। স্বাক্ষর প্রদান অনুষ্ঠানে তার পুত্র মাইকেল ডগলাস ও পুত্রবধূ ক্যাথরিন জেটাজোন্স উপস্থিত থাকায় প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। উন্নত দেশে স্বাক্ষর প্রদান, মোড়ক উন্মোচন বা প্রকাশনা উৎসব সারাবছর ধরেই কোথাও না কোথায় হয়। গতবছর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোশাররফ হোসেনের বই দুনিয়ার সব বড় শহরে একযোগে প্রকাশিত হয়ে বাজার মাত করেছিল। তার জন্য কোনো প্রকাশনা উৎসবের প্রয়োজন হয়নি।
অনেকে বলবেন, তাদের বিশাল বাজার তাই তারা পারেন। কিন্তু সেখানেও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই প্রকাশিত হয়। সেই তুলনায় আমাদের পোটেনশিয়াল ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাভাষী জনগণ পড়ুয়া জাতি না- একথা সত্য নয়। বিশেষকরে বাংলাদেশের বাঙালিরা যথেষ্ট বই পড়েন। তারা বই না পড়লে কলকাতার বই এতো ভাল চলে কী করে! আমাদের দেশে বহু পাঠক আছেন। তারা কেবল ঢাকা শহরে বাস করেন না। তারা ছড়িয়ে আছেন সমগ্র বাংলাদেশে। কিন্তু তারা হাতের কাছে বই পান না। বইমেলা প্রসঙ্গে নানা কথা বলা হয়ে গেল। বইমেলায় লাখ লাখ দর্শক না এসে যদি প্রকৃত গ্রন্থ প্রেমিক, গ্রন্থ সমালোচক, লেখক, প্রকাশক, বই বিক্রেতা, গ্রন্থাগারিক এবং অন্যান্য গ্রন্থকর্মী সমবেত হন এবং নিজেদের কাজের মূল্যায়ন, আলোচনা করেন ও মত বিনিময় করেন তবে সম্ভবত একুশে বইমেলা সত্যিকার অর্থেই বইমেলা হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)