সরকারী দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপিরা এবং কতিপয় বিরোধী দল, যেমন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী প্রমুখ দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং জাতীয় পার্টি নামক দলের নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান ও অতীতের সংসদ সদস্যরা অন্তত: একটি বিষয়ে একমত। একই ভাষায় তারা হামেশাই বলে থাকেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতার রোল মডেল’।
ওই সুরে সুর মেলাতে পারলে তো ভালই হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা পারি না। প্রতি বছর নির্বিবাদে নানাভাবে ঘটে যাওয়া ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলী অতি নিষ্ঠুরভাবে মনে করিয়ে দেয়: না, বাংলাদেশ আর অতীতের মত অসাম্প্রদায়িক দেশ তো নয়ই বরং তা অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক দেশ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ দিন দিনই বিবর্ণ হয়ে পড়ছে মুখ থুবড়ে পড়ছে।
সেই ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’ বলে যারা বাংলাদেশকে হরহামেশা উল্লেখ করে থাকেন, সম্প্রতি সাতক্ষীরার একটি গ্রামে নির্মিত ৪টি কালীমূর্তি এবং নির্মাণাধীন ৫০টি সরস্বতী মূর্তি এক রাত্তিরেই ভেঙ্গে দিল-তার আগে চট্টগ্রামের একটি গ্রামে অনুরূপভাবে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল তা তাদের চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না পুলিশেরও। এজাহার ওসি ও কিছু সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল ঘুরে গেলে, চা-বিস্কুট খেয়ে বিদেয় নিলেন। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। শেষতক দেখা গেল, মামলাগুলির তদন্ত শেষ হলো না, কেউ গ্রেফতার হলো না-আদালত পর্যন্ত পৌঁছালো না এই মারাত্মক অপরাধ এবং অপরাধীরা।
কোন এমপি বা মন্ত্রী গেলেন কি ঘটনাস্থল দেখতে? না। কারণ দেশটা তাদের দৃষ্টিতে ‘সাম্প্রদায়িকতার নয়’- তার মূলোচ্ছেদ হয়ে দেশটি ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে” পরিণত হয়েছে। যা ঘটে তা কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা না-বরং সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। বিচ্ছিন্ন্ ঘটনামাত্র।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত? না, তা কেন হবে? একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মের ব্যাপারে, মসজিদ ভাঙ্গলে বা কোরআন শরীফের দু’একটি পাতা পুড়লে সেগুলিই শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে ওগুলি কে করেছে বা আদৌ তেমন কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে না দেখেই শ্রেফ গুজবের ভিত্তিতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার ‘মুমিন’ কে জড়ো করে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামকে গ্রাস, অসংখ্য মন্দির, শত শত কপি রামায়ন, মহাভারত, গীতা, বেদ, উপনিষদ পুড়িয়ে ছাই করে দিলেও এবং এ জাতীয় ঘটনা প্রতিবছর দেশের নানাস্থানে ঘটতে থাকলেও এগুলি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ মাত্র।
এই যে দ্বৈত নীতি-মুসলিমদের ক্ষেত্রে “ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে ঘটলে তা ধর্মের অবমাননা” বলে তাকে উপেক্ষা করে যাওয়া এবং মাধ্যমেই কর্তাব্যক্তিরা প্রমাণ করে চলেছেন এদেশে মানুষ মূলত: দুই ভাগে বিভক্ত একভাগ সংখ্যাগুরু-আর এক ভাগ সংখ্যালঘু। এই চেতনা যে পাকিস্তানী চেতনা, আদৌ ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয় বরং তার সম্পূর্ণ বিরোধী এমন বাস্তব এবং বিরাজমান পরিস্থিতিকে তারা কেউই আমল দিতে প্রস্তুত নন। উল্টো সর্বোচ্চ মহল থেকে নিত্য নিয়ত দাবী করা হয় “বাংলাদেশে কেউ সংখ্যালঘু নন”। এতটাই অন্থত্বে আমরা দিব্যি ভূগে চলেছি।
এই নিবন্ধ লেখাকালে আরও একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর চোখে পড়লো। তার শিরোনাম হলো “চাটমোহরে আদিবাসীসহ ছয়টি পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা”।
খবরে বলা হয়: পাবনার চাটমোহর উপজেলার হাণ্ডিয়াল ইউনিয়নের বাঘলবাড়িয়া কৈ গ্রামে আদিবাসী সহ ছয়টি ভূমিহীন পরিবারকে তাদের বাড়ী ও জমি থেকে উচ্ছেদের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্র। জাল দলিল তৈরী করে জমি বন্দোবস্ত জবরদখল করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে চক্রটি। উচ্ছেদ আতংকে দিনাতিপাত করছেন তারা।
আদিবাসী ও ভূমিহীনদের উচ্ছেদের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিগত ২৫ জানুয়ারি দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। তাতে বলা হয়, হাণ্ডিয়াল বাঘলাবাড়ি কৈ মৌজার ভি.পি. কেস ভূক্ত ভূমির প্রকৃত মালিক প্রতিভা নাথ রায়, পিতা রাজা রায়, দিঘাপতিয়া, নাটোর। এই জমি উকিল উদ্দিন দিং ১৯৭৬ সালে জনৈক সাদায়ী প্রামানিকের কাছ থেকে খরিদ করে। অত:পর উকিল দিং আজগর আলী মোল্লার নিকট ১৯৮৫ সালে বিক্রী করেন। এই জমির ভোগদখলকারী এলাকার আদিবাসী ভূমিহীনরা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই জমির মধ্যে থাকা পুরুর নিমগাছি মৎস্য প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়। এ সময় উকিল উদ্দিন চাটমোহর সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। মামলায় উকিল উদ্দিনের দলিল জাল বলে প্রমাণিত হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে উকিল উদ্দিন আপিল দায়েল করেননি। পরবর্তীতে এই অর্পিত সম্পত্তি (মূল হিন্দু মালিক এদেশে না থাকার সুবাদে) নিজের বলে দাবী করে আজগর আলী মামলা করেন। আজগর আলী মারা যাবার পর তার তিন ছেলে আবদুস সোবাহান, শামসুল আলম ও সাইফুল ইসলাম ভিপি কেসভূক্ত করার জন্য আবেদন করেছেন অথচ আবদুস সোবহান নিজেও ৪৪৭ নং দাগের ৪৫ শতাংশ জমি একসনা লিজ নিয়ে ভোগ দখল করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, এই তিন ভাই একসনা লিজ প্রাপ্ত আদিবাসী ভূমিহীনদের উচ্ছেদের জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয় সর্বশেষ সরকারী গেজেটে এই জমি প্রতিভা নাথ রায়ের বলে উল্লেখ করা হয়। গেজেটে উকিল উদ্দিন কিংবা আজগর আলী দিং এর নাম নেই। আর.এস. রেকর্ডও তাদের নামে নয়-তাদের কোন বৈধ কাগজপত্রও নেই।
সংবাদ সম্মেলনে ভূক্তভোগিরা সরকারি সম্পত্তি রক্ষাসহ একসনা লিজ বলবৎ রাখা সহ আবদুস সোবহান গং এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়।
এ ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন অথবা অসাম্প্রদয়িক ঘটনা বলা যাবে? অতীতে বিচারহীনতায় ভোগা অসংখ্য ঘটনাকেও? এই ঘটনাবলী এবং অতীতের অনুরূপ হাজার হাজার ঘটনা দেশের প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। সাম্প্রদায়িককতাও বাহাত্তরের সংবিধান এর বিরোধী। তবুও ঘটনাগুলি হাজারে হাজারে ঘটেছে, ঘটছে এবং নিরন্তর ঘটেই চলেছে। আইন ও সংবিধান ও প্রতিনিয়ত সংকিত হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ যে সাম্প্রদায়িকতা ও কর্মান্ধতা তিলে তিলে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে তাই আর সময় না দিয়ে দেশের সকল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সকল সামাজিক শক্তির রাজপথে প্রতিরোধের সময় এসেছে অনেক আগেই। সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠলো কুখ্যাত প দশ সংশোধনী দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ও বামপন্থী সহ বিদগ্ধ সমাজের তীব্র বিরোধিতা সত্বেও পাশ করার পর থেকে।
আরও সরকারি অনুমোদন বা সরকারি আন্তরিক আনুকুল্য যে মুহুর্ত থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে সসম্মানে তুলে আনা হলো সেই মুহুর্ত থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সারা দেশে নবোদ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেশের নানা স্থানে ঘটে যাওয়া সত্বেও সরকারি নীরবতা যে উচ্চমহল থেকে প্রকাশ্য বা গোপন অনুমোদন প্রাপ্ত-তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
এই প্রক্রিয়া ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তাবৎ নীতি আদর্শের সুষ্পষ্ট পরিপন্থী হওয়া সত্বেও এবং হেফাজত কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্ত জানার সাথে সাথে ওই প্রতিকৃতি যদি প্রকৃতই নির্মাণ করা হয়-তা ভেঙ্গে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হবে” বলে হুমকি দিতে সহাস পেলো। শুধু তাই না, অঘোষিতভাবে হলেও ওই ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হলো। এর দ্বারা ধর্মান্থরা তাদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে তীব্র ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ করল তার কাছে নতি স্বীকার করে আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয়ই দিলাম না-বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশ্রদ্ধা জানাতেও কুণ্ঠিত হলাম না।
তাই তাদের চাপে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর গৌরবজনক অর্জনগুলি একে একে সকলের চোখের সামনেই বিপর্য্যস্ত হতে থাকলো। আজতা মহা রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধান “বিসমিল্লাহ্” দিয়ে শুরু করেননি, করলো জিয়া। জেনারেল জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতা পাকাপাকি করার লক্ষ্যে “বিসমিল্লাহ্” লিখে বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিরোধী পদক্ষেপ নিলো- জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকেও সাংবিধানিক বৈধতা দিল। অপরপক্ষে জেনারেল এরশাদ গেলাসে চুমুক দিয়ে বাহাত্তরের বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত সংবিধানে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সংযোজিত করে মুসলিম সমাজকে ধর্মের নাম পুরপুরি দিয়ে ক্ষমতা স্থায়ী করার পদক্ষেপ নিয়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বিরুদ্ধে এক সুষ্পষ্ট বার্তা দিলেন। পরবর্তীতে আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার সংশোধনী পাশ করে বাহাত্তরের বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত সংবিধানের খোলনলচে পাল্টানোর দুই সামরিক শাসকের কীর্তিকে স্থায়ী রূপ দিলেন। এই কার্যক্রম একদিকে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের স্পষ্ট বিরোধীতা করা এবং তা তথাকথিত সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতা ও ভোটের স্বার্থে যে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে- তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। সংশোধনীতে “বিসমিল্লাহ্” ও “রাষ্ট্রধর্মের” সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করা হলেও এ দুটি পরস্পরের সুষ্পষ্ট বিরোধী।
তাই এমন এক রাষ্ট্রীয় নীতি প্রচলিত থাকলে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কোন সামাজিক আন্দোলন চালু না থাকলে কালী মূর্তি, সরস্বতী মূর্তি, দুর্গামূর্তি, মন্দির, গীর্জা অহরহ ভাঙ্গতে সাহস কেন সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি পাবে না?
তদুপরি এগুলির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপও অনুপস্থিত। এ এক তাজ্জব দেশে পরিণত করা হলো মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে।
মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে, সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বা তা দেখেও না দেখার ভান করে হাজার টা পদ্মাসেতু, শত শত রূপপুর প্রকল্প ইত্যাদি দেশকে সমৃদ্ধ করবে না- সমৃদ্ধ করতে এবং সামাজিক রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, মূর্তি, মন্দির, গীর্জা ভাঙ্গা বন্ধ করতে বা কমিয়ে আনতে পারে বাহাত্তরের মূল সংবিধান পূনরুজ্জীবন, সকল অপরাধীর বিচার বা আওতায় আনার মাধ্যমে। নইলে দুর্গা, কালী, সরস্বতি পূজা তবুও অনুষ্ঠিত হবে তবে ভগ্ন হৃদয়ে এবং অশ্রু ঝরা নয়নে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)