করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েসের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া সিলেট-৩ আসনে করোনার ভয়াবহতার সময়ে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ বা লকডাউনের সময়েও সেখানে চলছে প্রচার-প্রচারণা। এই প্রচারণায় প্রার্থীরা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, তেমনি কর্মী সমর্থকেরাও। অন্য সকল ক্ষেত্রে প্রশাসন স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে নানা দণ্ড দিলেও এক্ষেত্রে নির্বিকার। বলা যায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের মহোৎসব। নির্বাচন করতেই হবে- এমন পণ নির্বাচন কমিশনের। তাই করোনা মহামারির সময়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলো, প্রার্থী বাছাই হলো, মনোনয়নপত্র দাখিল হলো। এখন চলছে প্রচার প্রচারণা। লকডাউনের মধ্যেই হবে ভোটগ্রহণ।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ বছরের ১১ মার্চ মারা যান সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস। তার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে করোনার কারণে প্রথমে উপনির্বাচনের তফসিল পেছায় নির্বাচন কমিশন। এরপর সেই করোনার সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। তারিখ পেছানোর সর্বশেষ পর্যায়ে আগামী ২৮ জুলাই হবে এই আসনের উপনির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে এই মুহূর্তে জমজমাট উল্লিখিত নির্বাচনী এলাকা। প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন পুরো এলাকা। জটলা পাকিয়ে গণসংযোগও করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানা ত দূরের কথা মাস্কটুকুও পরছেন না ভালোভাবে। মুখের মাস্ক থুঁতনিতে রাখছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার মাস্ক পরার ‘ঝামেলাতেই’ যাচ্ছেন না! প্রার্থীদের বাইরে কর্মী-সমর্থকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। সামাজিক দূরত্ব মানা ত দূরের কথা মাস্কের বিষয়টিই অজানা যেন তাদের কাছে। এমন অবস্থায় বাড়ছে ঝুঁকি।
লক্ষণীয় ব্যাপার, স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের এই প্রকাশ্য মহড়া সত্ত্বেও প্রশাসন পুরোপুরি নির্বিকার। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে নির্বাচনী প্রচারকার্য চালানো যাবে কি না এনিয়েও পরিস্কার করে কিছু বলছে না নির্বাচন কমিশন। যদিও নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত পরিপত্রের বরাত দিয়ে সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ৭ জুলাই পর্যন্ত সবধরনের প্রচার প্রচারণা ও সভাসমাবেশ নিষিদ্ধের কথা জানিয়েছিলেন। ৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনী প্রচারণা ৭ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকার পরের দিন থেকে ফের লকডাউন শুরু হলে এই সময়ে প্রচারণা চালানো যাবে কি না এনিয়ে পরবর্তীকালে জানানো হবে বলেও জানিয়েছিলেন। এরপর এনিয়ে তারা আর কিছু বলেনি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটেও এনিয়ে কোন ঘোষণাও আসেনি। সবশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে সিলেটের এই নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের দিন লকডাউন শিথিল থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
সরকার ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ‘শিথিল বিধিনিষেধের’ ঘোষণা দিয়েছে, তবে ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ বা লকডাউন দিয়েছে। গত ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা এবং ঈদুল আযহা পালনের সুবিধার্থে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এতদিন যে বিধিনিষেধ ছিল তা এই ৮ দিন থাকছে না বলে জানানো হয়। ঈদুল আজহার পর আগামী ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়। ওই ১৪ দিন পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানাও বন্ধ থাকাসহ এ সময়ে পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রে গমন ও জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন- বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিহার করার কথাও রয়েছে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে এই বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সিলেট-৩ সংসদীয় আসনে পুরোদমে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। এই প্রচারণায় প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা ও গণজমায়েত চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে করে করোনা সংক্রমণের চরম ঝুঁকিতে পড়েছে ওই এলাকার মানুষজন। সরকার একদিকে বলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা, আর অন্যদিকে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন (ইসি) সেই নির্বাচনের আয়োজন করে মানুষকে যে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে সেটা কি রাষ্ট্রের পরস্পরবিরোধী নীতি হয়ে দাঁড়াল না?
দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা এবং বালাগঞ্জ উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ আসন। এই সংসদীয় আসনের ভোটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। সারাবিশ্ব যখন করোনার মহামারিতে আক্রান্ত এবং বৈশ্বিক এই মহামারির সংক্রমণ রোধে সারাদেশ যখন কঠোর বিধিনিষেধের নামে লকডাউনে বন্দি তখন এই এলাকায় নির্বাচনের আয়োজন করে প্রায় দশ লক্ষ লোককে কি ঝুঁকি থেকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না? প্রার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের যে অনুশীলন এতে করে এই এলাকা কি আরও বেশি সংক্রমণের শঙ্কায় পড়ছে না? এমনিতেই গত মাস থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। সিলেটের করোনা সংক্রমণের যে তথ্য সেটাও বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত কয়েকদিন সিলেটে সংক্রমণ পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে সিলেটে সরকারি-বেসরকারি কোন হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেড কোন বেড খালি নেই, আইসিইউ খালি নেই।
এমনিতেই দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা করছে না। মানুষের মধ্যে সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। লকডাউন দিয়েও বেপরোয়া হয়ে ওঠা মানুষদের আটকানো যাচ্ছে না। মানুষ আক্রান্ত হবে-মরবে তবু সচেতন হবে না- এমন একটা অবস্থা চলছে। ঠিক সেই অবস্থায় প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের লাগামহীন গণজমায়েত, প্রচার-প্রচারণা ও উল্লিখিতদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার মত কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমন অবস্থায় সংক্রমণের যে ঝুঁকির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তার দায় কে নেবে?
সরকার কি এর দায় নেবে? নেবে না! প্রার্থীরা নেবে? তারাও না! কর্মী-সমর্থকেরা? না, তারা দায় নেওয়ার মত বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিকতা কিংবা অনুশীলনের পর্যায়ে নেই। নির্বাচন কমিশন, যারা এই মহামারির সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছে তারা কি নেবে? না, তারাও নিতে চায় না। দায় না নেওয়ার নানা যুক্তি তারা গত একবছর ধরে নানাভাবে তুলে ধরেছে। এনিয়ে অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে বগুড়া-১ আসনের ভোটগ্রহণের যুক্তি তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছিলেন- ‘করোনাকালে ভোট দিতে গিয়ে কোনো ভোটার যদি করোনায় অসুস্থ হয়ে মারা যান তার দায়ভার নির্বাচন কমিশন নেবে না’। [সমকাল, ১১ জুলাই ২০২০] গতমাসে বরিশালে পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় নির্বাচনে করোনার বিস্তার ঘটায় এমন যুক্তির সমালোচনা করে সিইসি বলেছেন- ‘করোনার চেয়ে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ’ [বাংলা ট্রিবিউন, ১২ জুন ২০২১]। নির্বাচন করোনার সংক্রমণে কোন প্রভাবই ফেলে না এমনটা প্রমাণ করতে সিইসির দাবি আমেরিকার নির্বাচনের পর করোনার সংক্রমণ বাড়েনি এবং পাশের দেশ ভারতের দিল্লিতে নির্বাচন না হলেও সেখানে করোনা বেড়েছে আর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হলেও সেখানে করোনা বাড়েনি। অদ্ভুত সব যুক্তি!
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করতে চায়। তারা মহামারি, করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকিকে পাত্তা দিচ্ছে না। যেকোনোভাবে নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যই তাদের। আবার নির্বাচন আয়োজনের সময়ে প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না এনিয়েও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা বারবার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। ‘সংবিধান রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি। ইসির যুক্তি, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ কারণেই নির্বাচন করতে হবে। আসন শূন্য হওয়ার পর থেকে তিন মাসের পর পরে আরও ৯০ দিন সময় নেওয়া হয়েছে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনের জন্যে। আগে যে সময়টুকু নেওয়া হয়েছে সেটা এই করোনার কারণেই। এরপর আর সময় নিতে রাজি না নির্বাচন কমিশন। তারা বারবার বলছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা। অথচ যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে মানুষকে মৃত্যুর পথ দেখানো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেই সংবিধানই নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধান বলেছে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার ইসি তা করবে। করোনার বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতিতে প্রকৃতই নির্বাচন করার পরিবেশ নেই। এমন পরিস্থিতিতে ইসি নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা নিজেরা এই সিদ্ধান্ত না নিলে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে পারে। ইসি সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের কাছেও যেতে পারে।
সংবিধানের একাধিক সংশোধনী নিয়ে সিদ্ধান্তের নজির আছে সুপ্রিম কোর্টের। ত্রয়োদশ সংশোধনী, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পথ দেখানোর যে নজির সেগুলো বহুল আলোচিত। তাই করোনা মহামারির সময়ে মানুষের জীবন রক্ষায় ইসি নিজেরা নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে। সেখানে মানুষের জীবনের মূল্য নিশ্চয়ই দেওয়া হতো। সিইসি জীবনের চাইতে নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, আবার নির্বাচন সংশ্লিষ্ট হয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে সেই দায় নির্বাচন কমিশনের নয় বলে যে অমানবিক মন্তব্য করছেন সেভাবে নিশ্চয়ই দেখবে না সুপ্রিম কোর্ট।
করোনার সময়ে নির্বাচন নিয়ে আশ্চর্যরকমের নমনীয় সরকার দল আওয়ামী লীগ। শক্তিশালী বিরোধীদলবিহীন নির্বাচন ব্যবস্থায় যেভাবেই হোক নিজেদের দলের আরও একজনের জয়লাভের সম্ভাবনা যেখানে প্রবল সেখানে তারাও চুপ। নির্বাচনের দায়িত্ব ও দায় সরকারের নয় বলে তারা অনেকটাই সেফজোনে বলে ভাবছে। অথচ টানা ও বিশাল ওইসব জনসমাগমের মাধ্যমে মানুষকে যে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে এ বিষয়টা অবজ্ঞা মানবিক সরকারের কাজ নয়। সরকারের দায়িত্বশীলেরা এনিয়ে সিইসির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মানুষের জন্যে রাজনীতি যেখানে সেখানে মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি আর যাই হোক ইতিবাচক রাজনীতি নয়।
যে আসনের এমপি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তার শূন্যতা পূরণ করতে করোনার ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তার এলাকার সাড়ে তিন লক্ষ ভোটারসহ অন্তত দশ লক্ষ মানুষের অধিকাংশের প্রিয় ছিলেন মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস। তার শূন্যতা পূরণে প্রিয় মানুষদেরসহ দেশের মানুষদের এভাবে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলবেন না! ইসিকে থামান, ইসিকে বুঝান, ইসিকে বলুন- উপনির্বাচনের চাইতে জীবন গুরুত্বপূর্ণ!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)