বাংলাদেশের মতো ভারতের অন্যতম প্রতিবেশি দেশ নেপাল। যার সাথে রয়েছে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সেটা রাজনৈতিক দল থেকে রাজপরিবার, সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে আত্মীয়তার পর্যায়ে। রাজা ত্রিভুবনের মৃত্যুর পর ১৯৬০ সালে ‘রাজকীয় অভূত্থান’ করে রাজা মাহেন্দ্র সর্বসময় ক্ষমতা গ্রহণ করে পরবর্তীতে চীন ও নেপালের সাথে সম্পর্কের উদ্যোগ নিলে নেপালে ভারতীয় প্রভাব সাময়িক ক্ষুণ্ণ হয়।
১৯৭২ সালে রাজা মাহেন্দ্রর পুত্র বীরেন্দ্র বীর বিক্রম সাহা রাজা হলে ভারতের সাথে সম্পর্ক আবার মজবুত হয়। রাজা মাহেন্দ্র চীন-ভারতের সাথে ভারসাম্য করার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ‘ইন্দো- নেপাল বানিজ্য চুক্তি’ ও ৬১ কিলোমিটার ‘চিকেন নেক’ ট্রানজিট চুক্তি করে ভারত ও বাংলাদেশের সাথে বানিজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন।
২০১৫ ও ২০১৬ সালে সীমান্ত সমস্যার কারণে জ্বালানি এবং ওষুধের ঘাটতিতে পড়ে ছিল নেপাল। মূলত ওই সঙ্কটের পর বিকল্প উপায় সন্ধানের চেষ্টা করে কাঠমান্ডু। বর্তমানে নেপাল প্রয়োজনীয় পণ্য চলাচলের জন্য কলকাতা ও বিশাখাপট্টম বন্দরের ওপরে নির্ভরশীল।
আর এই পক্রিয়ার অংশ হিসেবে চীনের সাথে একটি ট্রানজিট চুক্তি করতে চায় নেপাল। এর মাধ্যমে নেপালকে চারটি সমুদ্রবন্দর ও তিনটি স্থলবন্দর ব্যবহার করতে দিবে চীন। চীনের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরশীলতা কমবে।
এতদিন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেপাল ভারতের বন্দর ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক ক্রমেই বাড়ছে। নেপালে চীন ব্যাপক বিনিয়োগও করছে। আর এ নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ ঘণিভূত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবেও দেখছেন না। কারণ তারা মনে করেন এতে করে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।
ভারতের ২টি বন্দরের পাশাপাশি চীনেরও চারটি বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে নেপাল। জাপান, কোরিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আমদানির সময় চীনের বন্দর ব্যবহার করলে সময় অনেক বেঁচে যাবে, খরচও কম পড়বে।
বিষয়টি ভারতের জন্য কিছুটা হলেও চিন্তার বিষয়। কারণ কেবল বন্দরই নয় এখন থেকে চীনের স্থলপথেও বাণিজ্য করতে পারবে নেপাল। চারপাশে হিমালয়ে ঘেরা নেপাল বরাবরই ভারতের ওপর নিভরশীল ছিল। তবে এবার সেই নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে। সুযোগটি করে দিল চীন। নেপাল থেকে চীনের নিকটতম বন্দরের দূরত্ব ২ হাজার ৬শ’ কিলোমিটার। এর আগে দুই দেশের মধ্যে রেললাইন চুক্তি ইঙ্গিত দিয়েছিল নেপাল ও চীন কাছাকাছি আসছে।
ওই চুক্তির ফলে নেপালের ভেতর দিয়ে চীনা ট্রেন চলাচলের একটি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তিব্বত থেকে আসা এই রেলপথ চালুর বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে উভয় দেশ। এর ফলে ভারতের ওপর নেপালে নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল নেপাল।
বেইজিংয়ের সঙ্গে কাঠমান্ডুর প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী তিয়ানজিন, শেনজেন, লিয়ানিউঙ্গাং ও ঝানজিয়াং সমুদ্রবন্দর এবং লানঝো, লাসা ও শিগাতসে স্থল বন্দরের মাধ্যমে চীনের ভিতর দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করবে নেপাল। দুই দেশের ৬টি ডেডিকেটেড ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়েও মাল আনা-নেওয়ার সুবিধাও পাবে তারা।
ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির অসুবিধার কারণে ২০১৫ সালে চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছিল নেপাল; কিন্তু এখন বুঝতে পারছে তাদের উত্তরের চীন থেকে দক্ষিণে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করাই সুবিধাজনক। চীনের সঙ্গে তিক্ত ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাই তাদের ভারতমুখী করে তুলেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী লেখ রাজ ভাটিয়া কাঠমান্ডুর বিশিষ্ট সাংবাদিক হরিবংশ ঝাকে বলেছেন, চীনের সঙ্গে আদৌ ব্যবসায়িক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা উচিত কিনা সেটা পুনর্বিবেচনার সময় হয়েছে। অতিমারির অজুহাত দেখিয়ে চীন উতসবের মওশুমে পোশাক, জুতো, প্রসাধন সামগ্রী, বৈদ্যুতিক ও শিল্পের কাঁচামাল ভর্তি দুই হাজারেরও বেশি কন্টেনার আনতে দেয়নি নেপালকে। ন্যাশনাল ট্রেডার্স ফেডারেশনের সভাপতি নরেশ কাটুওয়াল জানিয়েছেন, নেপালি ব্যবসায়ীদের গত বছর ভিসাই দেয়নি চীন। এমনকি বাড়তি পয়সা খরচ করে কিছু চীনা সামগ্রীও তাদের কলকাতা বন্দর দিয়ে ঘুরপথে আনতে হয়েছে।
গরিব প্রতিবেশীর সঙ্গে চীনের এ ধরনের আচরণের কোনো ব্যাখ্যা একটাই- ওলির সরকারের পতনের আগাম গন্ধ পেয়েছিল বেইজিং। শর্মা ওলির কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) এবং প্রচণ্ডর কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাওইস্ট সেন্টার) মধ্যে সংযোগ ঘটাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। সেটা ব্যর্থ হয়। পায়ের নিচ থেকে পাটি সরতেই প্রচণ্ড সমর্থন তুলে নেয় ওলির ওপর থেকে। এরপর শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে নেপালি কংগ্রেস সরকার গঠন করে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চীনের বহুদিনের পরিকল্পনা মাওবাদীদের মদদ জুগিয়ে নেপালে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। বেইজিং জানে, নেপালের সঙ্গে ভারতের সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ককে নষ্ট করে নেপালকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতেই মাওবাদীদের সাহায্য নিয়ে চলেছে চীন। কিন্তু নেপালের মানুষই চীনা ষড়যন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
মেড ইন চায়না মানেই জিনিস টেকসই নয়। ধাক্কা খেয়ে নেপাল এটাও এখন ভালোই, বুঝতে পারেছে। নেপাল এয়ারলাইন্সের চীনের তৈরি দুটি এমএ ৬০ এবং ৪টি ওয়াই ১২-ই বিমান আছে। কিন্তু নিম্নমানের প্রযুক্তিতে নির্মিত বিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহনই দায় হয়ে পড়েছে। বেচতে চাইলেও খরিদ্দার নেই চীনা বিমানের। নেপালি মুদ্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন ঋণে আনা বিমান হাতি পোষার সমান হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে একটি চীনা বিমানের ইঞ্জিনে বিদ্যুত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় ল্যান্ডিংয়ে বিপত্ত ঘটে। অল্পের জন্য যাত্রী ও ক্রু মেম্বাররা প্রাণে বাঁচলেও বিমানটি অচল। নেপাল এয়ারলাইন্স বারবার অভিযোগ করলেও চীনা কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং নতুন করে বিমান বেচার প্রলোভন দেখিয়ে চলেছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পও ধুঁকছে নেপালে। ২০১৭ সালে নেপাল বিআরআই চুক্তিতে সাক্ষর করে। কিন্তু এখনো কাজ শুরু হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) অধীনে পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প নেপালে বিআরআইকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালে বিআরআই বা চীনের অন্যান্য বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন স্থানীয় মানুষরা। অনেকেই মনে করছেন পরিকাঠামো উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে নেপালে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে চায় বেইজিং।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের চুক্তি বাতিল করা থেকে শিক্ষা নিয়েছে নেপাল। নেপালের এই জনপ্রিয় পত্রিকাটির মতে, বিআরআইয়ের নামে ঋণের ফাঁদে পা দিতে চায়না কাঠমান্ডু।
নেপালের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী রাজেন্দ্র বলেছেন, বিআরআই প্রকল্পে নেপালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ কতোটা সুরক্ষিত থাকবে সেটা বিচার করা জরুরি। নেপালের মাটিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছুতেই ব্যবহার করতে দেওয়া যায়না।
বিআরআই প্রকল্পের অধীনে বুধি গন্ডকী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেরুং-কাঠমান্ডু রেলপ্রকল্পের ব্যাপক প্রভাব নেতিবাচক পড়বে পরিবেশের ওপর। এ বিষয়গুলোও ভাবাচ্ছে নেপালিদের।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল জোট নিরপেক্ষতা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান। নব্য উপনিবেশ রুখতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ‘নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিন্যাস’এর অন্যতম উদ্যোক্তা ভারত। বহির্বিশ্বের এমন নীতি নিয়ে আগালেও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী পাকিস্তানসহ অন্যান্য প্রতিবেশীর সাথে ভারতের সম্পর্ক প্রায়শই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী চীন, নেপালের সাথে সম্পর্ক প্রায় তলানিতে।
বড় প্রতিবেশী ভারতের সাথে এমন বাকযুদ্ধের মধ্যে কালাপানি লিপুলেখ ও লিম্পিওয়াধুরার ৩৩৫ কিলোমিটার এলাকাকে নিজেদের দাবি করে ‘রাজনৈতিক মানচিত্র’ প্রকাশ করে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয়েছে। সেই সংশোধনী বিলে নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী সাক্ষর করেছেন।
ভারত নেপালের এই সীমান্ত বিরোধ ১৮১৬ সালে সম্পাদিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে নেপালের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। চুক্তিতে কালি নদীকে দুই দেশের সীমান্ত ধরা হয়। সে মতে কালাপানি নেপালের হওয়ার কথা। কিন্তু ভারতীয় পক্ষের দাবি কালি নয় বরং কালির শাখা নদী লিম্বিয়াধৌরাকে ভুলে মূল নদী হিসাবে ধরা হয়েছিল।
তবে নেপালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে ২০০৮ সালে যখন রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রজাতন্ত্রিক নেপাল ঘোষণা করা হয়। ভারতের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক নেপাল তার জন্য সুখকর হবে। ২০১৩ সালে নেপালি কংগ্রেসের বিজয় ভারতকে সেই বার্তায় দিচ্ছিল। নরেন্দ্র মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভারতপন্থি নেপালি কংগ্রেসের সুশীল কৈরালা। মোদিকে শুভেচ্ছা জানাতে তার শপথ অনুষ্ঠানে উড়ে যান কৈরালা। প্রায় ১৭ বছর পর কোন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদিও নেপাল সফল করেন। নেপালের সংসদে বক্তৃতা দিয়ে প্রতিবেশীর মনও জয় করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ২০১৫ এপ্রিলের ভূমিকম্প সব এলোমেলো করে দেয়। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যর্থতায় সমালোচনার মুখে পড়ে কংগ্রেস সরকার। সে সময় ত্রাণ কূটনীতি নিয়ে নেপালের পাশে দাঁড়ায় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন।
একই বছরে নেপালের নতুন সংবিধান রচনা নিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয় নেপালের। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ মদহেশিদের অভিযোগ করেন, নতুন সংবিধানে এমনভাবে প্রদেশের সীমানা ভাগ করা হয়েছে যাতে সাতটির মধ্যে ছয়টি প্রদেশে মদহেশিদের ক্ষমতায় আসার কোন সম্ভাবনা নেই।
সংবিধানের বিরুদ্ধে ‘মদহেশীদের আন্দোলনের মুখে’ ভারত নেপালে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরই মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর নতুন সংবিধান গৃহিত এবং ১০ অক্টোবর সংসদে নেপালি কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন কমিউনিস্ট পার্টির কে পি শর্মা অলি। তখন জ্বালানি তেলের জন্য দেশজুড়ে হাহাকার। ভারতের অবরোধে বেকায়দায় পড়া কমিনিউস্ট প্রধানমন্ত্রীকে জ্বালানি তেল সরবরাহের করার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। অবরোধে ভুক্তভোগী নেপাল সরকার পরবর্তী বছর চীনের সাথে ট্রানজিট এন্ড ট্রান্সপোর্ট চুক্তি করে। যার মাধ্যমে চীনের চার সমুদ্র বন্দর ও তিন স্থল বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সাথে বানিজ্য করার অনুমতি পায় নেপাল।
তবে নতুন সংবিধানের অধীনে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বামজোট ক্ষমতায় আসলে চীনের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় নেপালের। এই সম্পর্কের দৃঢ়তাকে নেপালকে ভারতের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস যোগাচ্ছে। পরের বছর নেপাল বিমসটেকের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত জঙ্গি দমন মহড়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সমসাময়িক সময়ে চীনের মহড়ায় যোগ দিলে কূটনৈতিক ধাক্কা খায় ভারত। কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে কতক্ষণ সাহস দেখাতে পারবে নেপাল!
২০১৩-২০১৪ এর হিসাব মতে নেপাল তার মোট রফতানির ৬৬ শতাংশ করে ভারতে। নেপালের মোট বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ ভারতীয় কোম্পানির। প্রতিবছর তিন হাজার নেপালি ছাত্র ভারতে পড়তে যায়। ভারতে নেপালি নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট নিতে হয়না। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে মুক্ত ভিসা চুক্তি ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। ভারতে প্রায় ১৫ লক্ষ নেপালি কাজ করেন। আনঅফিশিয়ালি এই সংখ্যা ৭০ লাখ বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে নেপালে বাস করছে প্রায় ৬ লক্ষ ভারতীয়। মদহেশিরা ভারতীয়দের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। এছাড়া সাংস্কৃতিকভাবেও নেপালে ভারতের প্রভাব রয়েছে। অনেক নেপালি বলিউড ও ভারতের টিভি শো’তে এসে নিজের ক্যারিয়ার দাঁড় করিয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করে নেপালের বিখ্যাত গোর্খা রেজিমেন্টের ৪০ হাজার সদস্য। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া ৮০ হাজার নেপালি এখনো অবসর ভাতা পান ভারত থেকে।
কলকাতা বন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব ৯৩৩ কি.মি অন্যদিকে চীনের নিকটতম সমুদ্রবন্দরের সাথে দূরত্ব ৩৩০০ কিলোমিটার। ফলে অতিমাত্রায় চীন নির্ভরও নেপালের পক্ষে সম্ভব না।
নেপাল- ভারত সম্পর্কের অবনতিতে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে চলমান বাণিজ্যে ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করা হয়। ভারত-নেপাল-বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় রেল নির্মাণ প্রকল্প প্রায় চূড়ান্ত। এছাড়া ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনতে আগ্রহী বাংলাদেশ। তাই দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিকামী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রতিবেশী দুই দেশ বিরোধ মিটিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে সমুন্নত রাখুক।
কাঠমুন্ডুর রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী দিল্লীর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর গেছে নানা নাটকীয়তায়। সম্প্রতি মানচিত্র বিতর্কে কাঠমুন্ডু ও দিল্লীর চিরচেনা সম্পর্ক যেন হঠাৎ বদলে গেছে।
ভারতীয় পক্ষ অবশ্য বলছে চীনের উস্কানিতে নেপালের এমন আচরণ। কিন্তু ৭০ বছর ধরে কাঠমুন্ডুর রাজনীতির কলকাঠি নাড়া ভারতের বিরুদ্ধে কতক্ষণ সাহস দেখাতে পারবে নেপাল! নেপালে কি ভারতের দিন শেষ হতে চলেছে! নাকি সাময়িক উত্তেজনা শেষে দুই দেশ আবার বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠবে। সেই প্রশ্নই এখন বড় হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মাঝে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)