মাটির চিত্রী রামকিঙ্করের জন্মদিন ২৬ মে, ১৯০৬! তিনি নিজের হাতে বিশ্বভারতীর সার্ভিস বুকে তাই লিখেছেন! আসলে তিনি নিজেই বলতেন, ২৫ মে র মধ্যরাতের পর আমার জন্ম! পিতা চণ্ডীচরণ ছিলেন দরিদ্র, বাঁকুড়াতে ক্ষৌরকর্ম করতেন! মা সম্পূর্ণা দেবী, গৃহকর্মে নিজেকে রাখতেন ব্যস্ত! রামকিঙ্কররা দুই ভাই, চার বোন। ছোট বোনের মৃত্যু হয় জলে ডুবে! দাদা রামপদ। মামা বাড়ি বিষ্ণুপুরের কাদাকুলি পাড়া!
বাবার ক্ষৌরকর্ম করতে যেতেন বাঁকুড়ার আর এক বিখ্যাত মানুষ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে! তিনি খোঁজ নিতেন চণ্ডীচরণের কাছে, তার ছেলেদের নিয়ে! তিনিই চণ্ডীচরণের কাছে শুনে, রামকিঙ্করকে শান্তিনিকেতনে আনার ব্যবস্থা করেন! সেই ১৯২৫ এ প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ডাকে কিঙ্করের প্রথম একা একা বাঁকুড়া থেকে শান্তিনিকেতনে আসা! সেই শুরু অন্য জীবনের সঙ্গে! আমৃত্যু সেই জীবনের সঙ্গেই হেঁটেছেন রামকিঙ্কর বেইজ!
যুগী পাড়ায় সেই সময় একজন জাত মৃৎশিল্পী ছিলেন। তিনি কিঙ্করের অনন্ত জ্যাঠা! অনন্ত মিস্ত্রী বলেই সকলে চিনতো তাকে। ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়ায় কিঙ্করের নেশা দেখে তাঁকে খুব ভালোবাসতো অনন্ত মিস্ত্রী। বাঁকুড়ার লাল মাটিতে সেদিন প্রতিমা গড়াতে বেশ নাম কিনেছিলেন তিনি। যুগীপাড়ায় ছুতোর পাড়াতে বসে বসে, শেষ বিকালের আলোয় জীবন শিল্পের পাঠ নিচ্ছেলেন তিনি। গন্ধেশ্বরী নদীর নীল মাটি বড় প্রিয় হয়ে উঠেছিল সেদিন। সেই প্রেমের গন্ধেশ্বরী নদীর মাটি দিয়েই অনন্ত মিস্ত্রী প্রথম শিল্পের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন কিঙ্করকে।
অনন্ত বিভিন্ন মাটির প্রতিমা গড়তেন। তার মধ্যে বড় আপনার ছিল দুগ্গো মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ। ঠাঁই এ বসে একমনে গেঁথে গুরুর কাজ দেখতেন রামকিঙ্কর। দেখে দেখেই শিখতে পেরেছিলেন কাঁচা মাটির পাট। দো মাটি করা। অনন্ত জ্যাঠার পাশে থেকে ছোট খাটো ফাইফরমাস খাটতেন তিনি। সেই শুরু। প্রতিমা গড়ার কাজে মাটির সঙ্গে নিজের নিজেকে মিলিয়ে এগিয়ে চলা। মনের অজান্তেই অনন্ত মিস্ত্রীকে তাঁর ছেলে বেলার গুরু হিসেবে মনের কুলঙ্গিতে বসানো।
অনন্ত মিস্ত্রী গড়ছেন সরস্বতীর মূর্তি। আর পুজোর দিন পাঁচেক বাকি। এই সময় দারুণ ব্যস্ততা। রামকিঙ্কর এসে বসে থাকেন মাটির চালায়। দেখেন মূর্তি গড়ার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা কেটে যায়। রাম বসে আছে দেখে মাঝে মাঝে মনের দখল হারিয়ে ফেলে অনন্ত। সহ্য হয় না সহশিল্পীদের। সেই সময়েই একদিন সঙ্গীদের আচরণে বেশ কষ্ট পান অনন্ত মিস্ত্রী। তিনি তাদের আচরণে রুষ্ট হয়ে, কাজ থেকে তাদের অব্যাহতি দিলেন। চৈত্র আকাশের মতো বেশ উত্তপ্ত দেখাচ্ছিল কিঙ্করের অনন্ত জ্যাঠার মুখ। ভয়ে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করেছেন কিঙ্কর। হঠাৎ অনন্ত জ্যাঠার ডাক শুনলেন তিনি। নত মুখে কাছ গলে এগিয়ে এলেন রামকিঙ্কর।
: সরস্বতী গড়তে পারবি তুই। জিজ্ঞেস করলেন অনন্ত মিস্ত্রী। ঘাড় নাড়িয়ে মৌন স্বমতি জানালো কিঙ্কর।
: তবে হাত লাগা। আর তার আগে মায়ের বেদিতে একবার মাথাটা ঠুকে আয়। তাই করলেন কিঙ্কর। কাঠ কঞ্চির আড়ার গায়ে, খড় জড়িয়ে ঠাঁসা ঠাট বেঁধে, মাটির কাজ শুরু করলেন তিনি। গুরু দেখছেন শিষ্যের কেরামতি। দিন তিনেক নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজে মন দিয়েছিলেন রামকিঙ্কর। কাজ দেখে অনন্ত মিস্ত্রী বাকহারা। চোখে মনে খুশির উৎসব।
: ও রাম এ তুই কী গড়লি! কাছ মোড়া করে কাছে টেনে নিলেন কিঙ্করকে। ভ্রূকুটি চোখে খুঁটিয়ে পড়লেন কিঙ্করকে। এ যেন অন্যজীবনের পাঠ। আপনা আপনি নিজের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন মাটির চিত্রী। আর আকাশ গাঁথনি মনের রুপকথায় অনন্ত আঁকড়ে ধরে তার নিজের শিষ্যের আবদার। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার মতো অনন্ত বলতে থাকেন, ‘তোর হাতে সাক্ষাৎ মা এয়েচেনরে।’ সেদিন কতক আনন্দে কতক দুঃখে অনন্ত জ্যাঠার চোখে জল এসেছিল। মানুষটি যেন কেমন। খুশি হলেও চোখে জল, রেগে গেলেও দু’ চোখে শাওন নামে অবিরত।
তারপর থেকেই গুরুর অনুমতি মিলেছিল প্রতিমায় রং করার কাজে। কেবল চোখ আঁকবেন তিনি নিজে, এমনটাই ঠিক করেছিলেন নিজের মনে অনন্ত সুত্রধর। একদিন হঠাৎ অনন্ত মিস্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে, প্রতিমার চোখ আঁকতে তুলি ধরেন রামকিঙ্কর। মৃন্ময় মূর্তি যেন চিন্ময় হয়ে ধরা দিয়েছে। অনন্ত জ্যাঠা সুস্থ হয়ে ফিরলে অবাক হয়ে যায়। নতুন হাতে এমন অনুভব খুব বেশি দেখা যায় না। ভরসায় শান দিয়েছিলেন কিঙ্কর। শিল্পী অনন্তর মতোই রামকিঙ্কর চোখের তারা এঁকেছিলেন। কিঙ্করের সহযোগিতায় অনেক বেশি নিরাপদ হয়ে ছিলেন প্রবীণ শিল্পী অনন্ত সুত্রধর। তাই তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘দুর্গাতলার দুর্গা প্রতিমার জন্য আর আমার কোনো চিন্তা নেই। কিঙ্কর, তোকে আমি হাতে কলমে কিছু শিখায়নি বাবা। কিন্তু অনন্ত ছুতোর মরে গেলেও আর প্রতিমা পরবে না। তিনি শিল্পী তৈরি করে নিয়েছেন।’ কিঙ্কর মাথা নেড়ে জানিয়ে ছিলেন সেদিন, তাই হবে। তবে সে কথা বেশি দিন টেকেনি তার। বাঁকুড়ার মাটি তাকে আর বেশি দিন আঁটকে রাখতে পারেনি।
শিল্পী কিঙ্কর শান্তিনিকেতনের শিষ্যদের প্রায় বলতেন, ‘আমি ভূঁইফোড়। আমি অনন্ত জ্যাঠার থেকে দেখে দেখে কাজ শিখেছি। আমার প্রিয় গন্ধেশ্বরী আমাকে অনেক দিয়েছে। আমার প্রথম নারি, অবাধ্য তরুণ জীবন। কষ্টকর জীবনের পথে প্রথম তার বুকেই সাঁতার শিখেছি।’
যুগী পাড়ায় থাকার সময় অনন্ত মিস্ত্রী বলেছিলেন, ‘তুই আমার কাজ দেখে শিখেছিস ঠিকই কিন্তু আমি বলি কিঙ্কর তুই সাধক। তোর যা গড়তে ইচ্ছে করবে তুই তাই পারবি।’ সেদিনের কথাগুলো সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়িয়ে ছিলেন চিত্রী রামকিঙ্কর বেইজ।
সে সময় বাংলায় ব্রাত্যজনের দুর্গাপুজোর সময় তাদের অংশ গ্রহণে তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। পুজো হত জমিদার বাড়িতে। নতুবা কোনো ধনীদের বাড়িতে। সে সময়ই বাঁকুড়ায় সার্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজনের ব্যবস্থা করা হল। যেখানে সবার পিছে, সবার নীচে, সর্বহারাদের, সবারই অবাধ প্রবেশাধিকার। এমন উদ্যোগ নিলেন অনিলবরণ রায়, গোবিন্দপ্রসাদরা। সময়টা সম্ভবত ১৯২৫ এ। স্থান বঙ্গবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েছিল তখন পুজোর আর বেশি দিন বাকি ছিল না। এই নিয়ে গোটা এলাকা মেতে উঠেছে। এদিকে প্রতিমার মিস্ত্রীরা তখন সবই ব্যস্ত। কিঙ্কর তখনও শান্তিনিকেতনে যাননি। পাড়া থেকে ডাক পড়ল তাঁর। সাধারণ মানুষের দুর্গা প্রতিমা তাকেই গড়তে হবে। সকলের অগাধ আস্থা তাঁর উপর। তখনও সে ভাবে রামকিঙ্কর স্বাধীনভাবে প্রতিমা গড়েননি কখনও। চ্যালেঞ্জ এসেছে, তা গ্রহণ করতেই হবে। আশ্রমের আশু মহারাজ বললেন, ‘তোর উপর ঠাকুরের কৃপা আছে।’ সময় অল্প। এদিকে একটানা বৃষ্টি। রামকিঙ্কর নিরুদ্বেগ। তাকে পারতেই হবে। নিজের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সেদিন তিনি গড়েছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম দুর্গাপ্রতিমা। লক্ষ্মীর রং সোনালী। সরস্বতীর রং রুপালী। রঙের জন্যে ব্যবহার করেছিলেন মসিনার তেলে গোলা জামিরা পাতা। অপূর্ব সুন্দর ভাবনা। আলোয় মনে হয়েছিলো যেন গরীবের সোনার প্রতিমা। প্রতিমা দেখতে এলাকার মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন।
শান্তিনিকেতনে চলে আসার পরেও, তিনি দুর্গাপুজোর সময় বাঁকুড়ায় যেতেন। কারণ যতো দিন অনন্ত মিস্ত্রী বেঁচে ছিলেন, তিনি চাইতেন দুর্গার চক্ষুদান করুক রামকিঙ্কর। এমনই এক বছর দুর্গাতলায় ঢাক বাজছিল। কোলাহল মুখর দুর্গামেলা। রামকিঙ্কর এলেন শান্তিনিকেতন থেকে মণ্ডপে। প্রতিমার এবার চক্ষুদান হবে। ঢাকের বাদ্যি থেমে গেল। স্তব্ধ দুর্গামেলা। মণ্ডপের সামনে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা প্রতিমা। তখনও চক্ষুদান হয়নি। কেউ দেখতে পাবে না। দেখবে চক্ষুদানের পর, এটাই রীতি। তখন অনেকেই বাইরে অপেক্ষা করছে। সবাই দেখছে রামকিঙ্করের চুল ভেজা। উসকো খুসকো মাথার চুল, সদ্য স্নাত। কিঙ্করের পরনে ধুতি, খালি গা। কাঠের টুলের উপর উঠে দাঁড়ালেন রামকিঙ্কর। অনন্ত জ্যাঠা তুলে ধরেছেন, তালুতে রঙের পাত্র। রাম এবার প্রতিমার চক্ষুদান করছেন। কিছুক্ষণ পরে ধীর পায়ে টুল থেকে নামলেন মাটির চিত্রী রামকিঙ্কর বেইজ। একটু দূরে সরে গেলেন অনন্ত মিস্ত্রী। চোখ তার তখনও থেমে আছে মাটির দুগ্গোয়। রাঙা টকটকে দেখাচ্ছে অক্ষিগোলক। অনন্ত জ্যাঠার সঙ্গে অন্যান্য সাগরেদরা সবাই তখন অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। মণ্ডপ জুড়ে সাধারণ মানুষের ভিড়। কিঙ্কর নামলেন টুল থেকে। চোখ বুজলেন অনন্ত জ্যাঠা। হঠাৎ দু’ চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো। কারিগর যারা দাঁড়িয়ে আছেন তারা সরিয়ে দিলেন কাপড়। প্রতিমার চোখের দিকে চেয়ে আছে সবাই। এমন সময় ভিড় ঠেলা নারী কণ্ঠের স্বর, ‘জ্যান্ত দেখাচ্ছে মায়ের নজর!’
কিঙ্কর মণ্ডপের নীচে নামলেন। নত মস্তকে অনন্ত জ্যাঠাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘জ্যাঠা আমি যাচ্ছি!’
কিঙ্কর তুলি দুটি কালো পাত্রে রাখলেন। অনন্ত ছুতোর তাকালেন কিঙ্করের দিকে। রক্তাভ ঝাপসা চোখের আঁচলে বাঁধা মায়াময়। ‘মায়ের কি চোখ আঁকলি কিঙ্কর, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’