ভারতের আসামে হঠাৎ করে ৪০ লাখ মানুষ তাদের নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলেছে। দেশের অবৈধ অভিবাসীদের সরিয়ে ফেলতে তালিকা তৈরি করেছে ভারতের সরকার। সাধারণ বহু মানুষের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকযুগ ধরে বাস করা অনেকে এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাদের বংশধররাও বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। এরই মধ্যে বেশ বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে কী হবে? সত্যিই কি বিতাড়িত হবে আসামের ওই ৪০ লাখ মানুষ?
তালিকাটা কীভাবে হলো
রাজ্যেটির সবচেয়ে প্রথম নাগরিকদের তালিকা সবার কাছে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন বা এনআরসি নামে পরিচিত। সেটা ভারত ভাগের ৪ বছর পরে ১৯৫১ সালে তৈরি করা হয়। সেসময় পূর্ববঙ্গ থেকে লাখ লাখ মানুষ ভারতে চলে যায়।
সেই সময়ে রাজ্যটির হিন্দুপ্রধান অবস্থানে কোনো আঘাত আসতে পারে বিবেচনা করে এই তালিকাটিটি করা হয়েছিলো। কিন্তু সমস্যা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ১৯৭০ সালের দিকে। আর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করার আগেই আরো অনেক অনেক মানুষ ভারতে পারি জমায়। সেই সময়েও অনেক অনেক শরণার্থী আশ্রয় নেয় ভারতে।
এরপরে ১৯৭৯ সালে অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দ্বারা অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে একটি নতুন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেটাই ১৯৮৩ সালে সহিংস রূপ ধারণ করে যখন পুলিশ সন্দেহভাজন ২০০০ অভিবাসীকে হত্যা করে যাদের অধিকাংশই মুসলিম।
এরপর এই সংগঠন এবং অন্যান্য রিজিওনাল দলগুলো ১৯৮৫ সালে একটি চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেন সেখানে ফেডারেল সরকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে।
সেখানে বলা হয়, যারা ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখের আগে থেকে আসামে বসবাস করছে সেটা প্রমাণ করতে পারবে না তারা নির্বাচনের অধিকার হারাবে এবং তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। যদিও সেই চুক্তি কখনও প্রণয়ন করা হয়নি।
কেন এতবছরে তা পরিবর্তন হলো না
২০০৯ সালে অভিজিৎ শর্মা নামের একজন আদালতে পিটিশন করেন এনআরসির নতুন সংস্করণ করার জন্য। অতপর ২০১৪ সালে ফেডারেল সরকার তেমনটা করার নির্দেশনা দেন ২০১৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে।
৩২০ লাখ মানুষের তথ্য নিশ্চিতকরণ করে প্রথম ড্রাফটটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আর দ্বিতীয় ড্রাফটটি প্রকাশিত হয় এবছরের ৩০ জুলাই।
তালিকায় কারা আছেন
যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে আসামে এসেছেন তারাই আছেন এই তালিকায়। প্রত্যেককে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ দিতে হয়েছে। তার মধ্যে জমি ক্রয়, ভোটার আইডি বা পাসপোর্টও ছিলো। আর যারা ১৯৭১ সালের পরে জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাদের পূর্বপুরুষরা এই দিনটির আগে থেকে আসামে বসবাস করে আসছেন।
প্রায় ৪০ লাখ মানুষের নাম উঠেনি সেই তালিকায়। তাদের নাম নির্বাচনী ফর্ম থেকেও কেটে দেওয়া হয় কারণ তারা নিজেদের সঠিক নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি।
এরপরের প্রতিক্রিয়া
এরপরের প্রতিক্রিয়া ছিলো মিশ্র। সারা দেশের অনেক অনেক হিন্দু এটিকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির(বিজেপি) প্রশংসা করে। কারণ অন্যান্য কোনো রাজ্যের সরকারের এমন করার সাহস নেই।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে এটি একটি রাজনৈতিক নিপূণ পদক্ষেপ। আর বিরোধিরা এই পদক্ষেপের বিরোধিতাও করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেছেন পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এবং রাতের মধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে রাজ্যবিহীন করার জন্য।
রাহুল গান্ধী, মমতা ব্যানার্জীও এই ধরনের পদক্ষেপের প্রবল সমালোচনা করেছেন। পাশে দাড়িয়েছেন ওইসব মানুষদের। ভারতের সংবিধান ও হাইকোর্টের কিছু রায় ওইসব মানুষের পক্ষে কথা বলছে বলেও দাবি করেছেন তারা।
এটাই কি সর্বশেষ তালিকা?
সেখানকার সরকার এই ব্যাপারে খুবই খোলাখুলি রেয়েছে। তালিকায় নাম না থাকার বিষয়ে তারা আপিল করতে পারবে এবং নিজেদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে আরো কিছু তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করতে পারবে। তাই ধারণা করা যায় তালিকার নতুন সংস্করণে তাদের নাম থাকবে। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু চমকপদ ফলাফল তৈরি করেছে এনআরসি। সাবেক সার্ভিসম্যান, বর্তমান রাজনৈতিক নেতা এমনকি কিছু সরকারি কর্মচারীরও নাম বাদ পড়েছে এই তালিকায়।
এসব ছোট ছোট ভুলই পুরো রিপোর্টটাকে বাতিল করে দিবে বলে ধারণা অনেকের। আবার দেখা গেছে একই পরিবারের এক ভাইয়ের নাম তালিকায় রয়েছে অন্য ভাইয়ের নেই।
ইতিহাসে অনেকবারই বন্যার শিকার হয়েছে আসাম। সেই সময়েও অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন তাদের কাগজপত্র। ফলে নিজেদের পূর্ব অস্তিত্ব তাদের জন্য প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।
বড় আকারের পুশব্যাকের ঘটনা ঘটবে কি?
সেটা এখনো পরিস্কার না। তবে নরেন্দ্র মোদি বারবারই বলেছেন, অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের অবশ্যই বের করে দেওয়া হবে। তারা কোন দেশের নাগরিক ছিলেন তা যেমন স্পষ্ট না, তেমনি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আসামের অবৈধ অভিবাসী নিয়ে এমন কোনো অফিশিয়াল চুক্তি এখন নেই।
তাহলে কি সহিংসতার ভয়?
যাদের নাম তালিকায় নেই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নতো রয়েছেই। যদিও বাদ পড়াদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় জানানো হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে অধিকাংশই মুসলিম।
তবে এখনো সেখানে কোনো প্রতিবাদ বা সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। আপিল ও চ্যালেঞ্জের পরে প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকা প্রকাশ করার পরে সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন বিবিসির আসাম রিপোর্টার নিতিন শ্রীবাস্তব।। তিনি বলেন, যখন তারা উপলব্ধি করবে যে তারা তাদের ভূমি, ভোটাধিকার ও স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছে তখন সহিংসতা ঘটতে পারে।