প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে যত মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ। বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা সাধারণত একটা কল্পনার জগতে থাকেন। বিদেশের সবকিছুতেই আকর্ষণ তাদের। বৈধ উপায়ের পাশাপাশি অনেকে অবৈধ পথেও পা বাড়ান। অবৈধভাবে ঠিক কত মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরিনা সুলতানা জানিয়েছেন, অবৈধভাবে বিদেশগামীরা বিদ্যমান ইমিগ্রেশন সিস্টেম এড়িয়ে যাওয়ায় তাদের নাম কোথাও নিবন্ধন করা নেই। আবার অনেক সময় দেশ থেকে বৈধভাবে গেলেও গন্তব্য দেশে গিয়ে অনেকে অবৈধ হয়ে যান। যেমন অনেকে বিদেশে গিয়ে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। আবার কেউ কেউ স্টুডেন্ট, ভিজিট বা হজ ভিসায় গিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিদেশে থেকে যাচ্ছেন। এসব কারণে অবৈধ অভিবাসীর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
তবে সাগর পথে যারা যাচ্ছেন তাদের মোটামুটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮’র জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইটালি হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন ৮ হাজার ৭শ’ বাংলাদেশি। তাদের ৯৪ শতাংশ ভূমধ্যসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় নানা রকম শোষণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। আর ২০১৮ সালে তুরস্কে আটকে ছিলেন ২ হাজার বাংলাদেশি। তাদের ৯১ শতাংশ মরিয়া হয়ে বিদেশের পথে পাড়ি জমান। আর বাকিরা পরিবারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন।
আইওএম এর আরেকটি জরিপে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাওয়া অবৈধ অভিবাসীদের ৬৬.৭ শতাংশ এই ঝুঁকি নিয়েই বিদেশে যান যে, বৈধ কাগজপত্র না থাকায় গন্তব্য দেশে তারা গ্রেপ্তার, ফেরত পাঠানো ও নানা রকম হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। বিদেশ থেকে ফিরে আসাদের ৮১ শতাংশ জানিয়েছেন, বিদেশে তারা নানা শঙ্কায় দিন কাটাতেন।
এতো ঝুঁকির পরও এদেশের তরুণরা কেন বিদেশে যেতে মরিয়া?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী ফারুফুল ইসলাম বলেছেন, বিদেশ যাওয়ার পেছনে মূলত দু’টো ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করে। এগুলো হলো- ‘পুশ ফ্যাক্টর’ ও ‘পুল ফ্যাক্টর’। দেশে চাকরি প্রত্যাশীদের তুলনায় বাজার অনেক ছোট। তার ওপর চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকেই অদক্ষ কিংবা কম দক্ষ। এসব কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে তারা জায়গা করে নিতে পারেন না। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শ্রম বাজারে বৈষম্য তো রয়েছেই। সামাজিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এগুলো হলো পুশ ফ্যাক্টর। আর পুল ফ্যাক্টর হলো, বিদেশে উচ্চ মজুরি, নিরাপদ জীবন, নাগরিক সুবিধা, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার হাতছানি।
অধ্যাপক মারুফের মতে বিদেশের প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণের আরেকটি কারণ, স্বপ্ন দেখার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়া। পুরো সমাজে যখন ‘ফেয়ার সিস্টেম’ কাজ না করে তখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা ভঙ্গ হয়। দুই তিন দশক আগেও মানুষের মধ্যে স্বপ্ন কাজ করতো যে, ভালো পড়াশোনা করলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। কিন্তু এখন কর্মসংস্থান সঙ্কট ও দুর্নীতি তো আছেই, নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি, মাস্তানি, রাজনৈতিক প্রভাব- এসব কারণে সব সম্বল পুঁজি করেও ব্যবসায় সফল হওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে চাকরি পেলেও অনিয়মের কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয় না। সব মিলে সমাজে ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, এদেশে থেকে কী হবে? তাই বিদেশে যেতে পারলে ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে এমন মানসিকতা কাজ করে।
বিদেশ যেতে মানুষের মরিয়া মনোভাবকে পুঁজি করে দালালচক্র শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা বিদেশ গমনেচ্ছুদের মধ্যে কল্পনার জগৎ তৈরি করে প্রলুব্ধ করছে। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এখান থেকে যে বেতনের কথা বলে বা চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে গন্তব্য দেশে যাওয়ার পর দেখছে আসলে তা না। দালালের দেয়া তথ্য যাচাই করার সুযোগ নেই। অধ্যাপক মারুফ বলছেন, ইনফরমেশন অ্যাসিমেট্রি বা তথ্যের অসম বিন্যাসের কারণে অনেক তরুণ ঠকছে। দালালের ফাঁদে পা দিয়ে অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়ার পথে কিংবা বিদেশে পৌঁছে হাজারো সঙ্কটে পড়ছে।
বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম- বোয়াফ এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অভিবাসন ব্যয় অন্য দেশের তুলনায় বেশি। তার ওপর দালালদের দৌরাত্ম্যে এই খরচ আরও বেড়ে যায়। বিদেশ গমনেচ্ছুরাও রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যে চুক্তি হয় তা অনেক ক্ষেত্রে ভালোভাবে না পড়েই সই করেন। এর ফলে বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশিত বা প্রতিশ্রুত বেতন না পেলেও বাধ্য হয়ে বেশিরভাগই বিদেশে থেকে যান।
নাজমুল আহসান আরো জানান, অবৈধ দালাল চক্রের অনেকে মানব পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত। তারা বিদেশ গমনেচ্ছুদের বিভিন্ন অফার দিয়ে তা গোপন রাখতে বলেন। এক্ষেত্রে স্বপ্ন বিক্রি করে বেশি টাকা নেয়া এবং অবৈধভাবে বিদেশ পাঠালেও প্রমাণ না থাকায় দালাল চক্র ও রিক্রুটিং এজেন্সি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
আইনে কী আছে?
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত অভিবাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন ২০১৩’ করা হয়েছে। আইনের ২৬ নম্বর ধারায় আছে, বিদেশে যাওয়ার আগে অভিবাসী কর্মীর অভিবাসন প্রক্রিয়া এবং কর্মসংস্থান চুক্তি বা বিদেশে কাজের পরিবেশ সম্পর্কে জানার এবং বিভিন্ন আইনগত অধিকার সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনের ৩১ নম্বর ধারায় রয়েছে, অবৈধভাবে বিদেশে কর্মী পাঠানো, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অর্থ নেয়া বা নেয়ার চেষ্টা বা চুক্তি করানো এবং অভিবাসী কর্মীর কাগজপত্র বৈধ কারণ ছাড়া আটকে রাখার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং এক লাখ টাকা জরিমানা হবে।
আইনের ৩৪ নম্বর ধারায় বাংলাদেশ থেকে বহির্গমনের নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থান দিয়ে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনের বাস্তবায়ন কতটুকু?
বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম-বোয়াফ এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছেন, অভিবাসন বিষয়ে যে আলাদা আইন রয়েছে এটি খুব কম মানুষই জানেন। এমনকি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ যারা এই বিষয়ে কাজ করেন তাদেরও অনেকেই আইনটি সম্পর্কে জানেন না। তাছাড়া আইন থাকলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ প্রমাণের অভাব, দালাল চক্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজস, টাকার বিনিময়ে মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় আইনের বাস্তবায়ন হয় না।
অবৈধ অভিবাসন রোধ করার কী উপায়?
অবৈধ অভিবাসন রোধে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা, মেধা ও দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়নের উপর জোর দিচ্ছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা। অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধে সবার আগে জনসচেতনতার ওপর জোর দিয়ে অভিবাসী আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, দালাল চক্রকে আইনের আওতায় আনা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিবাসনবান্ধব হওয়ার কথা বলছেন বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
রামরু’র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরিনা সুলতানা বলছেন, অবৈধ অভিবাসনে যুক্ত দালাল চক্রের পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা, শাস্তির জায়গাটা আরো কঠোর করে তা নিশ্চিত করা জরুরি। গণমাধ্যমকেও আরো জোরালো ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী ফারুফুল ইসলামের মতে, দেশের চাকরি বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আর তা হলে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। তিনি আরো বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ, তবে নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন তথ্যের স্বচ্ছতা। দেশে ও বিদেশে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য যোগ্য করতে দক্ষতা বাড়ানো, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। বিদেশে গিয়ে ভালো কাজের জন্য সেদেশের ভাষাটা জানা জরুরি উল্লেখ করে ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন অধ্যাপক মারুফ।
নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা ও অবৈধ অভিবাসন রোধে প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সততা আর দায়িত্বশীলতা জরুরি। সবচেয়ে জরুরি দেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন দেখার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)