প্রতিটি সময়ের আলাদা রং আছে। একটু খেয়াল করলে ধরা যায় সময়ের রং। আকাশটা খুব কাছে। বিশাল ছাদের চারপাশ জুড়ে গাঁদা, সূর্যমুখীর সমারোহ। দেয়ালে দামী টেরাকোটা। বিদায়ী মাঘে বসন্তের আগমনী। অপালা আসেন অপরাহ্ন আভায়। নীলের আভিজাত্য ছড়িয়ে। শাড়িতে কিংবা চাদরে ছড়ানো নীল। আসেন অপলা বসু, কপালে টিপের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে। গলায় পাথরের নান্দনিক মালা আর দুই হাতে রুচিশীল নকশার বালায় পূর্ণ বাঙালিয়ানায় আসেন একজন অপলা বসু।
পরিবার জুড়ে ছিল সাংস্কৃতিক বাতাবরণ। মা খুব ভালো গান করতেন। তবে কোন অনুষ্ঠানে গাইতেননা। ঘরোয়াভাবে গান করতেন। ফলে আমার মনে গান ছিল। আর বাবার কাছ থেকে মিলেছে কবিতা। অসংখ্য কবিতা বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতা কণ্ঠস্থ ছিল বাবার। তার নিয়মিত পড়বার সুবাদে সেগুলো ছোট অবস্থাতেই কানে গেঁথে গিয়েছিল। মায়ের সুর আর বাবার কবিতা সেই নিয়ে শৈশব। আর শৈশবের বড় অংশ জুড়ে ‘গীতবিতান’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান নয় পাড়ার সংগঠন এই গীতবিতান। মা সেখানে যেতেন এবং সঙ্গে করে শিশু অপালাকে নিয়ে যেতেন। কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ইংরেজী স্কুলের একটা সেন্ট জোন্স ডায়সেশন স্কুল থেকে টেন। যে স্কুলে বিপ্লবী বীণা দাশ পড়েছিলেন। কলেজ লোরেটা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ। ইতিহাসে ।
বাবা এবং স্বামী দুজনেরই বাড়ি বাংলাদেশে। যদিও সেসময় অবিভক্ত ভারতবর্ষ। বাবার বাড়ি পাবনায় এবং স্বামীর বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের অব্যবহিত পরে বাবা চলে আসেন কলকাতায়। অপালা বসুর জন্ম ভবানীপুরে ১৯৬১ সালে। বাবার সেই পাবনায় আর যাওয়া ওঠেনি। এবারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হয়ে উঠেনি। বাবা অশোকগোবিন্দ চৌধুরীর কাছে দেশভাগের যন্ত্রনা শুনেছেন অনেকবার। অপালা বসু নিজেও ভাবেন ভাষায়-সংস্কৃতিতে এক একটি অঞ্চল ভাগ হওয়ার কি খুব দরকার ছিল? আবার এও ভাবেন এটি হয়ত অনিবার্য ছিল। শুধু সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের নিয়মিত সুযোগ থাকুক এটি মনে প্রাণে চাওয়া তার। এতে দূরত্ব কমবে যেমন তেমনি বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।
৩১ জানুয়ারি ঢাকা ছাড়ছেন অপালা বসু। এবারও বাপের জন্মভিটা না দেখতে পাওয়ার বেদনা তার রয়ে গেল। এর আগে ২০০০ সালের দিকে ইউরোলজির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে ফরিদপুরে শ্বশুরের ভিটায় এসেছিলেন। সন্তান এবং নাতনিকে নিয়ে আবারও আসার ইচ্ছা রয়েছে।
সংগীতের জন্য এপার বাংলা মানে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে, এ নিয়ে তৃতীয়বার আগমণ। প্রথম ২০১১ সালে। রবিরাগের আমন্ত্রণে। দ্বিতীয়বারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল রবিরাগ। ২০১৩ তে। ৫ বছর পর আবার বাংলাদেশে। তবে এবার স্বদেশ ভারতবর্ষের বাংলাদেশ দূতাবাসের পরিচালনাধীন আইজিসিসি (ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার) এর আমন্ত্রণে এসেছেন। একক পরিবেশনায়। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে পরিবেশন করেছেন সম্প্রতি তার একক সংগীত সন্ধ্যা।
লন্ডনের দশ বছরের জীবনকে বিরতি বলে মনে করেন অপালা বসু। তবে সে জীবনটাকে উপভোগও করেছেন। সন্তান, মাতৃত্ব, কম্যুনিটি আড্ডা এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। সেখানেও নিয়মিত ছিল রবীন্দ্রনাথ। দুই কন্যার জীবন অপালা বসুর। বড় কন্যা চিকিৎসক। ছোট জন গ্রাফিক ডিজাইনার। মা অপালা বসু বলেন, ওরা গায়না গান তবে প্রচন্ড সংগীত পছন্দ করে। বিশেষ করে পিয়ানোটা দুজনেই ভালো বাজায় বলে জানান দক্ষিণ কোলকাতার ভবানীপুরের এই শিল্পী।
যিনি দেড় যুগ আগে গড়ে তুলেছিলেন সুরলোক। যেখানে সময়ের বাস্তবতায় অসম্পূর্ণ গাইয়ে জীবনের নারীরা সদস্য হয়েছিলেন। তাদেরকে গান শেখানোর এবং রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে তুলে দেবার চেষ্টা করে চলেছেন।
বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীত চার্চার সম্পর্কে ধারণা আছে? প্রশ্নে অনেকটা যেন বুলেট ছুঁটে যাওয়ার ভঙ্গিতে উত্তর আসে। ‘কেন থাকবেনা? আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বন্যাদি (রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা) অসম্ভব জনপ্রিয়। সাদী মুহাম্মদ সবার শ্রদ্ধায় রয়েছেন। অদিতি মহসিন এর গান শোনা হয়। একটু অন্য স্বরে অপালা বসু বলেন, রবীন্দ্র চর্চায় বাংলাদেশে একজনের নাম এত শুনেছি এবং পড়েছি, তিনি সনজিদা খাতুন। তার সঙ্গে দেখা করবার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। তিনি সনজীদা খাতুন। এবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কত কথা যে হল। তিনি নিজের স্বাক্ষর করা একটি গ্রন্থ দিয়েছেন ‘রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ’ নামে। এটা আমার জন্য দারুণ একটি প্রাপ্তি।
অপালা বসু মনে করেন, যত দিন যায় মানে বেলা ফুরিয়ে আসে তখন রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি উপলব্ধিগোচর হয়। তার ভাষ্য, যত জীবনের অপরাহ্ন গাঢ় হচ্ছে তত রবীন্দ্রনাথ কাছে আসছে। সত্যরে লও সহজে বানীকে হৃদয়াঙ্গম করতে পারছি। মেনে নিতে শিখেছি এক জীবনে সব কিছু মিলবার নয়। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে শিখিয়েছে জীবনের প্রতিটা দিন ভালোবাসার।
বিখ্যাত আশা অডিও থেকে ‘প্রকৃতি ও প্রেম’ নামে কবিগুরুর গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে। এর আগেও দুটি অ্যালবাম বের হয়েছে। খুব ইচ্ছা অপালা বসুর পূর্বপুরুষের দেশ থেকে বের হবে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অ্যালবাম। যা স্মৃতির ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
আলাপনে ফুরিয়ে আসে অপরাহ্ন আলো। তিনি খোলা গলায় গান ধরেন। ‘বনে যদি ফুটল কুসুম…’। ছাদ জুড়ে থাকা জবা-সূর্যমূখীরা আনত হয়ে শোনে সে গান।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন