কেউ নিয়ে এসেছেন বেতের তৈরি নানা সামগ্রী, কেউ নকশা করা জামা, বিছানার চাদর, পোশাক। খাদ্যপণ্য, পুতুলের পসরাও বসিয়েছেন কেউ। কেউ এনেছেন পরচুলার মত আপাত অপরিচিত পণ্য। ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মিলিত হওয়া ব্র্যাকের নারী উদ্যোক্তাদের এই মেলার সব স্টলের পেছনে রয়েছে একজন করে সংগ্রামী নারীর গল্প।
আজ সোমবার ১৬ অক্টোবর বেলা ১১টায় শুরু হওয়া এই মেলা উদ্বোধন করেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন পার্কের বৈশাখী মঞ্চে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী এই ‘উদ্যোগের উৎসব’।
ব্র্যাক নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে, উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনী সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের পণ্য সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিপণনের উদ্দশ্যে “উদ্যোগের উৎসব” আয়োজন করে। ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির বিভিন্ন পণ্য এবং সর্বোপরি ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সর্ম্পকে আগতদের ধারণা দিতে সংস্থাটির একটি স্টলও রয়েছে এখানে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাজনীন সুলতানা। বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের সিনিয়র ম্যানেজার কাশফি বিনতে আহমেদ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, নারীদের হাতে অর্থ থাকলে তখন সেই অর্থ ইতিবাচক কাজে ব্যবহার হয়। সেটা সংসারে স্বাস্থ্য-শিক্ষার জন্য ব্যবহার হয়। নারীরা এ রকম উদ্যোগের সাথে যুক্ত থাকলে আমরা একটি সুস্বাস্থ্য সম্পন্ন শিক্ষিত জাতি পাব। তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমাদের সমাজে কুপমণ্ডুকতা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, চাকরি করতে হবে। সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করতে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।
নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাজনীন সুলতানা বলেন, নারীরা আয় করলে তা থেকে পরিবার উপকৃত হয়। তিনি বলেন, আপনারা সামনে এগিয়ে আসুন যাতে সংসারের হাল ধরতে পারেন। অনেক সময় স্বামীর অকাল মৃত্যু হলে বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে নারীরা দিশেহারা হয়ে যায়। সন্তানদের নিয়ে কীভাবে সংসারের খরচ বহন করবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। এরকম সময়ে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বা ব্র্যাক নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কোথায় হাত বাড়ালে আপনারা সহযোগিতা পাবেন, সেটা বুঝতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর অতিথিরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। এই স্টলগুলোর একটি মোসাম্মৎ বিলকিস খাতুনের। ১১ বছর আগে পরচুলা তৈরির কাজ শিখেছিলেন। এখন স্বামীকে নিয়ে তিনি পরিচালনা করেন তাসলিমা হেয়ার পার্ক। প্রায় ১ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে তারা কাজ করেন শেরপুরের নালিতাবাড়িতে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের পুরো প্রক্রিয়ায় মান নিয়ন্ত্রণের কাজটি এখনো নিজেই করেন বিলকিস। বাইরের ব্যবসা পরিচালনা করেন স্বামীর মাধ্যমে। নানা ডিজাইনে পরচুলা তৈরির প্রাথমিক কাজের পর তারা সেটি ঢাকায় তাদের পার্টনারদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে দ্বিতীয় স্তরের কাজ শেষে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয় এই পরচুলা। এরপর অধিকাংশ পরচুলা চলে যায় বিদেশের বাজারে।
রোকসানা পারভীন জামালপুর থেকে এসেছেন। স্বামীর ক্যান্সার হওয়ার পর এক যুগ আগে তিনি শুরু করেছিলেন হস্তশিল্পের কাজ। তখন ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি এই কাজ শুরু করেছিলেন। স্ত্রীর উদ্যোক্তা হওয়ার এই যাত্রায় শুরুতে সম্মত না থাকলেও মৃত্যুর আগে স্বামী বলে গিয়েছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর তোমাদের টাকার সমস্যা হবে না ভেবে ভালো লাগছে।” এরপর কেটে গেছে ১২ বছর। এখন জামালপুর শহরে শো-রুম নিয়ে নকশীকাথা, নকশা করা বিছানার চাদর, নকশা করা পোশাক বিক্রি করেন তিনি। তার হয়ে কাজ করছেন কয়েকশ হস্তশিল্পী।
সরাসরি ক্রেতাদের কাছে ব্র্যাকের নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিপণনের সুযোগ সৃষ্টি করা “উদ্যোগের উৎসব” আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা এবং পণ্যের বাজার সম্পর্কেও ধারণা নিতে পারবেন উদ্যোক্তারা। এসব দিক বিবেচনায় এই আয়োজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা প্রসারে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠি, বিশেষ করে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভূক্তি এবং বিভিন্ন ধরণের আর্থিক সেবা দিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় নারীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ার সাথে সাথে নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
ব্র্যাক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নারীদের আরও বেশি সুযোগ দেয়া হলে তারা সমাজ পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন। দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে এবং চলমান অর্থনীতিকে সচল রাখতে নারী উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি বর্তমানে ৫৫ লাখের বেশি নারী উদ্যোক্তা ও নারী সদস্যকে সরাসরি অর্থায়নের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখছে।