রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনের সাথে করা শস্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। এই চুক্তির ফলে এতদিন ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমে শস্য রপ্তানি করত। শস্য চুক্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ ইউক্রেন সূর্যমুখী, ভুট্টা, গম এবং বার্লি রপ্তানিকারকদের মধ্যে বৃহত্তম। এই চুক্তি থেকে রাশিয়ার সরে আসায় প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্ব বাজারে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে খাবারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আবারও দেখা দিবে খাদ্য সংকট।
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনে উৎপাদিত শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন সারাবিশ্বেই বেড়ে যায় খাদ্যের দাম কারণ ইউক্রেনে উৎপাদিত খাদ্য শস্য গুলো বন্দরেই আটকে ছিল। সারাবিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কায় ২০২২ সালের জুলাই মাসে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এই শস্য চুক্তি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
চুক্তির শর্তমতে, কোনো বাধা ছাড়া কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছায় ইউক্রেনের শস্য। গত এক বছরে তিন বার এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও গতকাল এই চুক্তি থেকে সরে আসে রাশিয়া।
কেন শস্য চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ?
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের কারণে ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি ব্যাহত হয়, যার ফলে কিছু দেশে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয় এবং বিশ্বজুড়ে দাম বেড়ে যায়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, ইউক্রেনে উৎপাদিত শস্য বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ কোটি লোকের খাবারের জোগান দেয়।
চুক্তিটির ফলে ইউক্রেন তিন কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন শস্য রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে। এই শস্যের বেশিরভাগই আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গেছে। আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইয়েমেনসহ বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোতে ইউক্রেনের শস্যর ব্যপক চাহিদা রয়েছে।
চুক্তিটি নতুন করে নবায়ন না হওয়ায় অফ্রিকা অঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণে শস্য ঘাটতি দেখা দেবে।
ইউরোপীয় কমিশনের মতে, ইউক্রেন বিশ্ব গমের বাজারের ১০ শতাংশ, ভুট্টার বাজারের ১৫ শতাংশ এবং বার্লি বাজারের ১৩ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। দেশটি সূর্যমুখী তেলের বাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
কী বলছে রাশিয়া?
ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোলে কৃষ্ণ সাগর রাশিয়ার নৌবহরে ইউক্রেনের ‘ব্যাপক’ ড্রোন হামলার অভিযোগ তুলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। তবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসলেও রাশিয়া জানিয়েছে, তাদের শর্ত পূরণ হলে তারা আবারও চুক্তিতে ফিরে আসবে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক করে বলেছিলেন, রাশিয়ার খাদ্য ও সার রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে মস্কো এই চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিবে।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করেছিলেন, রাশিয়ার খাদ্য ও সার রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার চুক্তিটি সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দরিদ্র দেশগুলোতে শস্য সরবরাহ করা হয়নি।
রপ্তানিতে আর্থিক লেনদেন, অবকাঠামো ও বিমার ওপর নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে রাশিয়ার শস্য ও সার রপ্তানিতে বড় বাধার সৃষ্টি করেছে। এসব বাধা দূর করে রপ্তানির সুযোগ দিলেই তারা চুক্তিতে ফিরবে।
বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া শস্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে জেলেনস্কি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাথে কথা বলেছেন। জেলেনস্কি এক টুইটে বলেছেন, এটি রাশিয়ার বিশ্বব্যাপী খাদ্য বাজারকে অস্থিতিশীল করার আরেকটি প্রচেষ্টা। এতে ইউক্রেনীয় খাদ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশের ৪০০ মিলিয়ন মানুষের জীবনকে বিপন্ন করেবে। সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি হবে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তার দেশ শস্য রপ্তানি চালিয়ে যেতে চায়। তিনি বলেন, আমরা ভয় পাই না। আমাদের জাহাজের মালিকদের সাথে যোগাযোগ করছি। জাহাজের মালিকরা বলেছেন, তারা শিপমেন্ট অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রস্তুত রয়েছে।
জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা পরামর্শ দিয়েছেন, ইউক্রেন থেকে শস্য বহনকারী জাহাজগুলোকে এসকর্ট করতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সশস্ত্র টহল বাহিনী তৈরি করা যেতে পারে। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, এমন টহল তৈরি করতে অনেক দেশ ইচ্ছুক নাও থাকতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন শস্য চুক্তিকে “অস্ত্র হিসেবে” ব্যবহার করার অভিযোগ এনেছেন।
ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন রাশিয়ার চুক্তি থেকে বের হয়ে আসাকে ‘নিষ্ঠুর পদক্ষেপ’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড এই পদক্ষেপটিকে “নিষ্ঠুরতার কাজ” বলে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রধান এনগোজি ওকোনজো আইওয়ালা বলেছেন, কৃষ্ণ সাগরে খাদ্য এবং সারের বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দামের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমাদের আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে মস্কো এর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে শস্যচুক্তির মেয়াদ আর বাড়াচ্ছে না রাশিয়া। এতে বিপাকে পড়তে যাচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ। আমরা মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধির সমাধান খুঁজে বের করবো যা অনিবার্যভাবে রাশিয়ার সিদ্ধান্তের কারণ হতে যাচ্ছে।
ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ তুরস্ক এবং জাতিসংঘের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ দুর্বল মানুষের ক্ষতি করে চলেছে।
পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেবিগনিউ রাউ একটি টুইটে বলেন, এটি দক্ষিণের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক আগ্রাসনের চেয়ে কম কিছু নয়।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি একে মানবতার বিরুদ্ধে আরেকটি অপরাধ বলে অভিযোগ করেছেন।