বিজ্ঞানীদের দাবি অনুযায়ী সমুদ্রের মাত্র ৫ শতাংশ আমাদের জানা। বাকি ৯৫ শতাংশের রহস্য আজও উদ্ঘাটন সম্ভব হয়নি। রহস্য উদঘাটনে দেশ-বিদেশের নানা সংস্থা সমুদ্রের গভীরে অনবরত সন্ধান চলমান। নব্বই দশকে এমনই এক অনুসন্ধানের সময়ে ধরা পড়ে এক অদ্ভুত জোরালো শব্দ। সেই শব্দের উৎপত্তিস্থল নিয়ে আজও রহস্য মেটেনি।
১৯৯৭ সালে আমেরিকার একটি সংস্থা ‘ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (‘নোয়া’ নামে অধিক পরিচিত) প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপর গবেষণা করতে সন্ধানে নামে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে স্তন্যপায়ী প্রাণীর বৈচিত্র কেমন, তাদের গতিপ্রকৃতি কী রকম— এই সব নিয়েই মূলত গবেষণা করতে চেয়েছিলেন নোয়া’র বিজ্ঞানীরা। হঠাৎ তাদের কাছে থাকা হাইড্রোফোন নামক বিশেষ যন্ত্রে ধরা পড়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের তলার প্রাণীদের মধ্যে নীল তিমির শব্দ সবচেয়ে জোরালো। কিন্তু তারা যে শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, তার আওয়াজ নীল তিমির শব্দের চেয়েও বহু গুণ বেশি। বিজ্ঞানীদের দাবি, হাইড্রোফোনে যে শব্দ ধরা পড়েছিল তার কম্পনের মাত্রা কম হলেও বিস্তার অনেক। প্রায় এক মিনিট ধরে এই শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন নোয়ার বিজ্ঞানীরা।
হাইড্রোফোন যন্ত্রের মাধ্যমে সমুদ্রের তলায় প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শব্দ ধরা পড়ে। হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এত জোরালো শব্দ ভেসে আসার পর তারা এই অজানাকে জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
শুধু মাত্র হাইড্রোফোন নয়, নোয়া’র জাহাজে লাগানো সেন্সরগুলিতেও জোরালো শব্দ ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই সেন্সরগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, প্রবল জোরের শব্দই এক মাত্র সেগুলিতে ধরা পড়ে। সেন্সরে শব্দ ধরা পড়া মাত্রই অবাক হয়ে যান বিজ্ঞানীরা। কোনও অজানা প্রাণী যদি এই শব্দ করে, তা হলে তার আকার নীল তিমির চেয়েও তিন গুণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এই বিশালাকার প্রাণী সমুদ্রের তলায় রয়েছে, তা যেন কল্পনাই করা যায় না।
বহু বছর ধরে এই অজানা শব্দ নিয়ে গবেষণা চালান নোয়া’র বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, ‘ব্লুপ’ নামের কোনও অজানা প্রাণীর আওয়াজ এটি। ২০১২ সালে নিউজ়িল্যান্ডের সমুদ্রসৈকত থেকে নীল তিমির এক নয়া প্রজাতির সন্ধান মেলে। বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, সমুদ্রের তলায় এখনও বহু অজানা প্রাণী রয়েছে, যাদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।
তবে বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই এই শব্দের উৎস সম্পর্কে অন্য রকম তথ্য দিয়েছেন। তাদের দাবি, জোরালো শব্দটি আসলে হিমবাহের শব্দ। যে সময় হাইড্রোফোনে শব্দটি ধরা পড়েছিল সে সময় পাঁচ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হিমবাহ ভেঙে পড়ছিল। তাই এত জোরে শব্দ শোনা গিয়েছে।
তাদের দাবি, প্রশান্ত মহাসাগরের যে জায়গা থেকে ব্লুপের শব্দ শোনা গিয়েছে তার সঙ্গে যোগ রয়েছে আমেরিকান হরর সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ এইচপি লাভক্র্যাফ্ট রচিত ‘দ্য কল অফ ক্থুলু’ গল্পের র’লিয়েহ শহরের। হররপ্রেমীদের একাংশের দাবি, গল্পে বর্ণিত র’লিয়েহ শহর থেকে ১৭৬০ কিলোমিটার দূরে ব্লুপের বাসস্থান। এই শহরেই কাল্পনিক মহাদানব ক্থুলু সুপ্ত রয়েছে।
র’লিয়েহ শহরে বর্তমানে এমন একটি দানবাকৃতির জীব বাস করছে, যার গর্জন হাজার হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত শোনা যায় বলে হররপ্রেমীদের দাবি। তবে বিজ্ঞানমনস্কেরা এই দাবিকে নেহাত মস্করা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্লুপ আসলে কী এবং এই শব্দ কোথা থেকে এসেছিল, সেই রহস্যের সমাধান আজও হয়নি।