রাশিয়ার ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিশিয়া গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন এবং দেশটির প্রতিরক্ষা সংস্থার মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এতে রাশিয়ায় তৈরি হয়েছে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি।
দক্ষিণ রাশিয়ার যে অঞ্চল থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের রণনীতি তৈরি করা হত, সেই অঞ্চলই হাতছাড়া হয়েছে বলে জানা গেছে। রাশিয়ার ভাড়াটে হিসেবে পরিচিত ওয়াগনার গোষ্ঠীই রুশ সেনার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। তারা রাশিয়ার সরকার পতনের হুমকি দিয়েছে। সকলের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ আসলে কি এবং চলমান এই পরিস্থিতি রাশিয়াকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
ঘটনার সূত্রপাত
ওয়াগনার গ্রুপ ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য এক বড় ভরসার জায়গা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে গোষ্ঠীটি। কিন্তু হঠাৎ করেই ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
প্রিগোজিন অভিযোগ করেন, দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শোইগু তার ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর রকেট হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই হামলায় তার বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ক্রেমলিন।
পরে শনিবার প্রিগোজিন টেলিগ্রামে একটি অডিও মেসেজ পোস্ট করে বলেন, তার যোদ্ধারা ইউক্রেন থেকে রুশ নগরী রোস্টভে প্রবেশ করেছে এবং যারাই তাদের থামানোর চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি যুদ্ধ করবেন। এর আগে রুশ কর্তৃপক্ষ প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
এই অবস্থায় রুশ প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, সংকট মোকাবিলায় সব ধরণের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কারও কারও অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাশিয়ায় যারা বিভক্তি তৈরি করবেন, তাদের অবশ্যই কঠিন সাজার মুখোমুখি হতে হবে। তিনি ওয়াগনার বাহিনী এবং এর নেতার বিদ্রোহের নিন্দা জানিয়ে কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ওয়াগনার গ্রুপ কী?
প্রিগোজিন ২০১৪ সালে ওয়াগনার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। বাহিনীটির প্রায় ৫০ হাজার ভাড়াটে সেনা ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই সাবেক বন্দী। যুক্তরাষ্ট্র এই বছরের শুরুতে একে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংগঠন হিসেবে মনোনীত করেছে এবং অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাহিনীটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
বাহিনীটি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার যুদ্ধক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে কাজ করেছে, যেখানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।
প্রিগোজিন ও পুতিনের সম্পর্ক
৬২ বছর বয়সী ইয়েভজেনি প্রিগোজিন একজন রাশিয়ান ব্যবসায়ী। তিনি ‘পুতিনের শেফ’ নামেও পরিচিত। চুরি-ডাকাতির অভিযোগ একবার ১৩ বছর কারাবাসের সাজা হয় তার।
আমেরিকান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য ‘ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি’ নামে একটি ফার্ম নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তাকে পুতিনের ডানহাত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
১৯৯০ দশক থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট এর সঙ্গে তার পরিচয়। ক্রেমলিনের বিভিন্ন খাবারের চুক্তি পাওয়ার মাধ্যমে ধনকুবের হয়ে ওঠেন তিনি। একসময় তিনি ‘পুতিনের শেফ’ হিসেবে পরিচিত পান।
ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াগনার
পুতিন ওয়াগনারের সাহায্যের প্রশংসা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ান বাহিনীর কাছে অস্ত্রের উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও পর্যাপ্ত উন্নত অস্ত্রের অভাব রয়েছে। রাশিয়ার কর্মীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই সবেমাত্র প্রশিক্ষিত। ওয়াগনারের বাহিনী রাশিয়ার স্থল আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং ২২০ দিনের বেশি সময় যুদ্ধের পর মে মাসে পূর্ব ইউক্রেনের শহর বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।
ওয়াগনার এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
প্রিগোজিন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ওয়াগনার কর্মীদের একটি ক্যাম্পে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। পরে পোস্ট করা একটি অডিও বার্তায় বলেছেন, তার ২৫হাজার জন সেনা এই বিশৃঙ্খলার অবসান করতে এবং সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তিনি এবং তার যোদ্ধারা ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে দক্ষিণ রাশিয়ার একটি শহর রোস্তভ-অন-ডন এবং একটি কৌশলগত সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশ করেছে। তারা মস্কোর দিকে অগ্রসর হবার কথাও জানিয়েছে।
যদিও ক্রেমলিন জানিয়েছে, মস্কোর চারদিকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা অস্বীকার করেছে। প্রসিকিউটররা ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ নিষিদ্ধ করার আইনের অধীনে ভাড়াটে প্রধানের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে। দেশটির ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস বলেছে, প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
তবে এই সংকটের সমাধান শেষ পর্যন্ত কিভাবে হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন সাবেক উপদেষ্টা সের্গেই মারকভ বিবিসিকে বলেন, সামরিক দিক থেকে বিবেচনা করলে পরিস্থিতি খুবই বিপদজনক। ওয়াগনার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে দশ হতে বিশ হাজার সৈন্য। এদের বেশিরভাগই এখন রোস্তভ শহরে। রোস্তভ শহর বেশ বড় শহর। দশ লাখের বেশি মানুষ আছে এই শহরে।
শহর এলাকার লড়াইয়ে ওয়াগনার গ্রুপ বেশ দক্ষ। বাখমুতের লড়াই থেকে আমরা এর প্রমাণ পাই। কাজেই সামরিক পথে এই সমস্যার সমাধান বেশ কঠিন হবে। তার মতে, ক্রেমলিন তাই অন্যভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বিষয়টি ‘একটি অভ্যন্তরীণ রাশিয়ান সমস্যা’ যা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি ঘনিষ্ঠভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছেন। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেননি।
এছাড়াও পোল্যান্ড, ফ্রান্স ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানা গেছে।
পুতিনের জন্য এর অর্থ কী?
অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ম্যাথিউ সাসেক্স বলেছেন, এই বিরোধ পুতিনের শাসনামলের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক হয়েছে। এটি যুদ্ধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর মনোবলকে ভেঙে দেবে।
পুতিনকে এখন ঘরে এবং ঘরের বাহিরে, সব জায়গাতেই লড়াইয়ে নামতে হবে।