গত ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ২৫ দিনের মধ্যে ১৪ দিন সারাদেশে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচী পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ডাকা এই হরতাল-অবরোধে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক যানবাহনে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায়। এবার আগুনে পোড়ার তালিকায় রয়েছে দুটি ট্রেন। প্রাণ ঝরেছে একাধিক।
দূরের যাত্রীরা খুব জরুরি না হলে ভয়ে যাত্রা শুরু করেননি। তাই দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা বাধাগ্রস্থ করা গেছে। এরই মধ্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে।
এতো গেলো সারাদেশের প্রভাব। কিন্তু আমাদের এখন দেখা দরকার, এই হরতাল অবরোধের বিনিময়ে কী পেলো বিএনপি-জামায়াত জোট? তারা কি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা বন্ধ রাখতে পেরেছে? মানুষের নির্বাচনমুখী হওয়া কী ঠেকানো গেলো? বরং দিন দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। কল্যাণ পার্টির মত দল, যারা শুরুতে তফসিলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তারা নির্বাচনের ঘোষণা দিচ্ছে।
আমরা এখন বলতে পারি বিএনপি-জামায়াত জোট যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন করছে, তার কোনোটারই ফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি। যেমন সরকার পদত্যাগ করেনি। নির্বাচন কমিশনও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত হয়নি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোট শরিক, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্যরা নির্বাচনী ট্রেনে চড়তে প্রস্তুত। এরইমধ্যে তারা প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে।
একইভাবে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। সাবেক কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারের নেতৃত্বাধীন প্রয়াত নাজমুল হুদার সংগঠন তৃণমূল বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সর্বশেষ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে তিনটি সংগঠনের জোট যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ এই কল্যাণ পার্টি এতোদিন বিএনপি জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলো। ছিলো আন্দোলন সংগ্রামেও।
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে তাতে বিএনপির মাঠ পর্যায়ে অনেক নেতা নির্বাচন অংশ নেবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে থাকলেও তাদের দলের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। দলের মধ্যে যারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, কিংবা যাদের বয়স হয়ে গেছে, রাজনৈতিক জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহীরা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। তাই দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে আর কী কী ঘটতে যাচ্ছে- তার জন্য আগ্রহীদের আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এখন আরেকটি প্রশ্ন খুব সামনে চলে এসেছে, সেটা হচ্ছে সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত জোট, বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা কি দলীয় কর্মসূচী নিয়ে মাঠে আছেন? তারা কি ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে থাকতে চাচ্ছেন? যদি সরকার পতন না হয়, নির্বাচন ঠেকানো না যায়- তাহলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কি হবে? এরকম আরও অনেক জটিল প্রশ্নের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন মাঠের কর্মীরা। কারণ এরইমধ্যে বিভিন্ন মামলার কারণে বহু কর্মী জেল খাটছেন। সক্রিয় নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই নিজের বাড়িতে থাকতে পারেন না।
মাঠের নেতাকর্মীরা্ও কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। কারণ যেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগেই কারাগারে আছেন। তাই যারা বাইরে আছেন তারাও গ্রেপ্তার এড়াতে, আত্মগোপনে আছেন। এমন কি যিনি প্রতিদিন দলের মূখপাত্র হিসেবে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচী ঘোষণা করছেন, বিএনপির সেই সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও অদৃশ্য জায়গা থেকে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে কর্মসূচী ঘোষণা করছেন। অনেকটা নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের মতই চলছে তাদের কার্যক্রম। দারুণ সুযোগ সুবিধার এই সময়ে এই জীবন তো কারও কাম্য নয়।
বিএনপি যে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচী দিচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। কিন্তু এ ধরণের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই। সেই কাজটি বিএনপি গত ১৫ বছরেও করতে পারেনি। ফলে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা হয়নি। শুধু দলীয় নেতাকর্মী দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জন করা যে সম্ভব নয়- আমার ধারণা সেটা আজও বিএনপি বুঝে উঠতে পারেনি। বর্তমান বাস্তবতায় যে বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধ একটা ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে সেটাও বিএনপির নেতৃত্ব বুঝতে পারছে না।
একটা বিষয় খুবই পরিস্কার যে, আন্দোলনের ডাক দিয়ে কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগের দিনে জ্বালা-পোড়াও করে জনমনে ভীতিকর একটা অবস্থা তৈরি করে হরতাল-অবরোধ সফল হয়ে গেছে- এই মনোবাসনা নিয়ে এসি রুমে বসে থাকলে আন্দোলন কখোনই সফল হবে না। আর সেই আন্দোলন যে মোটেই জনকল্যাণকর নয়, সেটাও নিশ্চিত। সেখান থেকে ইতিবাচক ফল আসবে না এটাও বলে দেয়া যায়। বিএনপি কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত, দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। তারা এখন কারও স্বার্থসিদ্ধি বা ক্ষমতায় বসানোর বা ক্ষমতা থেকে নামানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান না।
এখন এই সহজ অঙ্কগুলো বিএনপি-জামায়াত জোট নেতাদের বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, ২০১৩-২০১৪-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল সেই ইতিহাস তাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এবারও যদি তারা নির্বাচন প্রতিহত করতে নামে, এবং সেই সহিংস পথে হাঁটে, তাহলে তাদের জন্যে খুব সুখকর কিছু যে আসছে না, তা যে কেউই বুঝতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)