দেশব্যাপী জরায়ু মুখ ক্যান্সারের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে এবং এই রোগ প্রতিরোধে যিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তিনি দেশের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক সেহেরীন এফ. সিদ্দিকা। আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি গাইনি এবং অবস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। জানুয়ারি মাস ছিল ‘জরায়ু মুখ ক্যান্সার’ সচেতনতা মাস। ‘জরায়ু মুখ ক্যান্সার’ এর ভয়াবহতা এবং চিকিৎসা বিষয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে।
জানুয়ারি মাস ‘জরায়ু মুখ ক্যান্সার’ সচেতনতা মাস। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সেহেরীন এফ. সিদ্দিকা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ডব্লিউএইচও জানুয়ারি মাসকে ‘জরায়ু মুখ ক্যান্সার’ সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করে আসছে। বিশ্বজুড়ে এই মাস পালিত হচ্ছে। এই সচেনতার মাস পালনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা তাদের ওয়েবসাইটে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এ বছরে যে বিষয়গুলো ওপর জোর দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- রোগ শনাক্ত করা, ভ্যাকসিনেশনে অভিগম্যতা তৈরি করা এবং এই রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা তৈরি করা। এ বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মৃত্যুঘাতী রোগ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা। আমরাও সব জায়গাতে খোলামেলাভাবে বলছি ‘ভয় নয়, প্রয়োজন সচেতনতা’। আসলে এটি খুবই জরুরি। এই রোগ সম্পর্কে যদি আমরা সচেতনতা তৈরি করতে পারি তাহলে এই রোগ নির্মূলে আমরা অনেক এগিয়ে যাবে।
দেশে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২ হাজার বিভিন্ন বয়সী মেয়ে বা নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়। দুঃজনক হলেও সত্য, একই সাথে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে থাকে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একটি মাত্র টিকার মাধ্যমে এই রোগ শতভাগ নির্মূল করা সম্ভব। আমরা এই কথাটিই সর্বত্র বলছি। আজকে দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ যে সচেতনতা বিষয়ক আলোচনা সভা, র্যালির আয়োজন করছে। সেখানেও আমরা একই কথা বলছি, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বার্তা দিচ্ছি। আমাদের দেওয়া বার্তা এখন তৃণমূলে পৌঁছে গেছে। আশার সংবাদ স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরাও এখন এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে।
এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সমূহের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশি রক্তস্রাব, দুই মাসিকের মাঝে রক্তক্ষরণ, সহবাসের পরে রক্তপাত, মেনোপজের পরে রক্তপাত।
নারীদের কারা এই রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা কম বয়সে বিবাহ করে, যাদের অনিয়মিত মাসিক, যারা ধূমপান করেন, যাদের একের অধিক যৌনসঙ্গী রয়েছে এবং যারা অধিক সন্তান ধারণ করে থাকে। আমি এই কথাগুলো সর্বত্র বলছি। আসলে উল্লিখিত এসব বিষয়ে আমাদের সচেতন হতেই হবে। আমাদের মোটেও অবহেলা করার কিছু নেই। আর এখন যাদের সামর্থ রয়েছে তাদের উচিত হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা নেওয়া। এই টিকা এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গত অক্টোবরে কিন্তু বাংলাদেশ সরকার, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (গ্যাভি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহায়তায় পক্ষ ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ২৩ লক্ষ মেয়েদের বিনামূল্যে এই টিকা দিয়েছে।
জরায়ু মুখ ক্যান্সার রোগ শনাক্তকরণের পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে সেহেরিন এফ. সিদ্দিকা বলেন, ২১ বছর বয়স থেকে নিম্নলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ পূর্ববর্তী অবস্থায় এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। এর জন্য ভায়া টেস্ট, কলোপ্সকপি, প্যাপ টেস্ট, এইচপিভি টেস্ট করা প্রয়োজন।
রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি জানান, ১০ বছর বয়স হলেই একটি হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টিকা নিলেই এই ক্যান্সার শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর ১৪ বছর হলে তাদের দুটি ডোজ নিতে হবে। ১৪ বছরের ওপরে হলে তিনবার নিতে হবে।
ডা. সেহেরিন এফ. সিদ্দিকা বলেন, এই ক্যান্সার থেকে বাঁচার উপায় ভ্যাকসিন নেওয়া। আমি বলবো যারা ঝঁকিপূর্ণ গ্রুপে রয়েছেন তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন নেওয়া। আর সচেতনতার কথা আগেই বলেছি। রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমরা সবাই মিলে কাজ করলে জরায়ু মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে আমরা জয়ী হবে। আমাদের জয়ী হতেও হবে।