বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নির্বাচনী আবহ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মানুষের উৎসাহের অন্ত নেই। আগামী ৭ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ৩০টি দল।
এবারের নির্বাচন বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যবহ। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা এবং নাটকীয়তার দৃশ্যপটে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভিন্নমাত্রা যোগ করছে। যেহেতু গণতন্ত্র ও সংবিধানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ অপরিহার্য, তাই নির্বাচন ছাড়া একটি আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কোনো গত্যন্তর নেই।
প্রকৃতিগতভাবেই বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি, তাই নির্বাচন ঘিরেও এই জাতির উত্সাহের অন্ত নেই। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্যও নির্বাচন জরুরি। এক্ষেত্রে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত দেশ ও জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত। পরিতাপের বিষয় শুধু বর্জন নয়, নির্বাচন প্রতিরোধের নিমিত্তে জ্বালাও-পোড়াও-হত্যা-সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্যের আশ্রয়ও নেওয়া হচ্ছে।
আমরা দেখেছি রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ হত্যাকাণ্ড, যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে, যা সভ্য সমাজে কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ বিএনপি এই ঠুনকো দাবি নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চদশ সংশোধনী (১০ মে ২০১১) ও সবক’টি প্রধান দলের সম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিত করে দেয়।
এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর মধ্য দিয়ে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এতে সংবিধানের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। তাই নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ধরে পুরো জাতি যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বিএনপি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনী প্রচারণার জোয়ার, তখন বিএনপির হরতাল-অবরোধসহ যাবতীয় অপরাজনীতির কৌশল ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এছাড়াও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শান্তিপ্রিয়, তারা ধ্বংসাত্মক কিছু পছন্দ করে না। তাই হরতাল অবরোধের অস্ত্রও ভোতা হয়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এদেশের জাতীয় জাগরণ ও দিকনির্দেশক পরিবর্তনের সূচক হিসেবে কাজ করেছে নির্বাচন। যেমন ১৯৫৪ সালের ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর বিজয় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক মুসলিম লীগ শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক চপেটাঘাত ছিল।
বাঙালির আত্মপরিচয় শনাক্ত ও স্বতন্ত্র চিহ্নিত করার নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল। ৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ও নিরঙ্কুশ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। তখন মাওলানা ভাসানী যদিও স্লোগান তুলেছিল- ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ কিন্তু ওই ভোট বর্জন করলে বাঙালিরা তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭০’র নির্বাচনে বিজয় কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের তকমা পড়াতে পারেনি বহির্বিশ্ব। তাই বিএনপি’র এই ভোট বর্জন কোনভাবেই বুদ্ধিপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া যায় না।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আরেক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে বিশ্ব মোড়লরা। যুক্তরাষ্ট্র নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপ করছে আমাদের নির্বাচনে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এই অযাচিত হস্তক্ষেপ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমেরিকা স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে, বিএনপি সূক্ষ্ম কারচুপির ভিত্তিহীন কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ তুলে তাদের দূতাবাসে ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি। ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে
অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। আমরা কারো তাবেদার নই, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরাই নেব।
বিদেশি কোনো শক্তির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আমাদের দেশ চলবে না। বিধিমতো সরকারব্যবস্থা পরিবর্তিত হবে। আমাদের আছে পবিত্র সংবিধান, এর ভিত্তিতেই দেশ এগিয়ে যাবে। বিএনপি-জামায়াতচক্রের গাত্রদাহের মূল কারণ হলো, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোডম্যাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে।
আমরা নিম্নআয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছি। শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। আগামী ২০৩৯ সালের মধ্যে উন্নত দেশের পর্যায়ে উপনীত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গার্মেন্টস ও জনশক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ক্রমশ বাড়ছে। চিংড়ি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এছাড়াও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি ক্ষেত্র হলো শান্তিরক্ষী মিশন।
বাংলাদেশের ক্রমশ উন্নয়ন ও অর্জন অপশক্তির গাত্রদাহের কারণ। তাই বাংলাদেশকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায় এসব নব্য পাকিস্তানিরা। এদেশের কোনো কল্যাণ তারা আনেনি আগামীতেও আনবে না। তাদের ব্যাপারে দেশের জনগণের সতর্ক ও সচেতন হওয়া দরকার। বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা দৃশ্যমান উন্নয়নের নিরিখে স্পষ্ট। আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছি। এছাড়া ঢাকায় মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি এ সরকারের অনন্য কৃতিত্ব।
অদূর ভবিষ্যতে পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আরও অনেক মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এসব কৃতিত্ব শেখ হাসিনা সরকারের সুশাসন ও নেতৃত্বের ফসল। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা সরকার দেশের গ্রামীণপর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ।
দেশ ডিজিটালাইজড হওয়ার পথে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমবাজার রপ্তানির হার দিন দিন বাড়ছে। ভাতা, বিধবা ভাতা ইত্যাদি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা হচ্ছে আবাসন। এসব উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য দেশ পরিচালনায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অপরিহার্য। বিএনপি-জামায়াত জোট জানে তারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাই তারা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়। পেছনের দরজা দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে জল ঘোলা করছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এবারে নির্বাচন বর্জনের পরিকল্পনা বিএনপিকে জনগণ থেকে আরও দূরে সরে নিয়ে যাবে। ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য মেন্ডেট হলো একটি স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনকে ম্যানুপুলেট করে ক্ষমতায় আসতে চায়।
অতীতে আমরা চার চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচন দেখেছি, তা কি শতভাগ নিরপেক্ষ? একমাত্র বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছাড়া আর কেউ নিরপেক্ষ হতে পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যে শতভাগ নিরপেক্ষ হবে তার নিশ্চয়তা নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেখানে নির্বাচন কমিশন রয়েছে সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন আসে কেন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে তো নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে ক্ষমতা পরিবর্তন হয় এতে তো কারও দ্বিমত নেই, প্রশ্ন নেই। তাহলে আমাদের বেলায় এতো কথা ওঠে কেন?
আসল ব্যাপার হলো গণতন্ত্র চর্চা ও প্রয়োগ। আমাদের সমাজ গণতন্ত্রের বিধি মেনে আরও সুসভ্য ও পরিশীলিত হয়ে উঠুক তা কি বিএনপি-জামায়াত চায় না?
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠবে তা স্পষ্ট। ইতোমধ্যে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ৩০টি নিবন্ধিত দলের প্রার্থী ও বহু সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। তাই নির্বাচন ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনার ঘাটতি নেই, তা দৃশ্যমান।
আর বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন করার দৃষ্টান্ত তো এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রয়েছে। আর এখানে তো স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও একটা শক্তি। তাই আগামী নির্বাচন নিশ্চয়ই অর্থপূর্ণ হবে। যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে। দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অটুট থাকবে। এটিই কাম্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)