বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য এলাকার চাইতে উত্তরাঞ্চলের এবং ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর এর স্কুলগুলোতে টেক্সট বুক বিতরণ, মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পিছিয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সেইসব সরকারি ও বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বেশি চলছে যারা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর সহায়তা পেয়েছে। যারা এই সহায়তা পায়নি তাদেরটা কম চলছে।
মঙ্গলবার মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত ”বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা” শীর্ষক একটি সমীক্ষা রিপোর্ট উপস্থাপনকালে উপরোক্ত তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করার মাধ্যমে এর উন্নয়নের জন্য মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বহুদিন ধরেই পাহাড়ের ও সমতলের স্থানীয় সহযোগী সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন আদিবাসী নেটওয়ার্কের সাথে কাজ করছে। এই কাজের অংশ হিসেবেই ‘‘বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা” শীর্ষক একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছে ২০২২ সালের জুন মাসে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ যেসব শিক্ষক পেয়েছেন, তারাই এই কাজটা ভালভাবে করতে পারেন, তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং এই প্রশিক্ষণের সময়সীমাও খুব স্বল্পমেয়াদী এবং এই প্রশিক্ষণ শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের চেয়ে ভাষা শিক্ষার উপর বেশি আলোকপাত করে।
‘‘বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা” করতে গিয়ে দেখা গেছে এর সবচেয়ে এই ব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক শ্রেণীতে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা। দেখা গেছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সমস্যার কারণে শতকরা ৬০ ভাগ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। যেহেতু শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, টেক্সট বই এর বিষয় আদিবাসী শিশুদের কাছে অপরিচিত ও তাদের আকর্ষণ করতে পারে না, তাই অনেক সংখ্যক আদিবাসী শিশু ঝরে পড়তে বাধ্য হয়। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী আদিবাসী শিশুদের ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য সরকার মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোছাম্মৎ হামিদা বেগম, সচিব পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়। সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এমজেএফ এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
তবে পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসী দুই ক্ষেত্রেই বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ঠিকমত পরিচালিত না হওয়ার কারণ হলো সরকার থেকে কোন স্পষ্ট গাইডলাইন বা নির্দেশনা নাই, শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ সুবিধা নাই, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, বহুভাষাভিত্তিক টেক্সট বইয়ের অভাব এবং এই ক্লাস নেয়ার মতো শিক্ষক সংখ্যাও যথেষ্ট নয়।
প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের ধীরে ধীরে মাতৃভাষার মাধ্যমে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে মূলধারার শিক্ষায় প্রবেশের পদ্ধতিটি ঠিকমতো বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষায় কার্যকর করা যায়নি। যথাযথভাবে এই দুই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সেতু বন্ধন না হওয়ায় যেসব ছাত্রছাত্রীরা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে, তারা মূলধারায় পড়তে গিয়ে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
এখন পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং মাতৃভাষা শিক্ষা এই দুটি বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মধ্যে যথেষ্ট কনফিউশন আছে। অনেক শিক্ষকই বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে বাড়তি চাপ নিতে চায়না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নেয়ার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কেউ কেউ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে চান না। যদিও পার্বত্য জেলা পরিষদ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানকারী শিক্ষকদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করেছে কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়।
দেখা গেছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও শেরপুরের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলের নির্ধারিত গারো শিক্ষার্থীদের জন্য যে বই দেয়া হয়, তা ঠিকমতো গ্রহণ করা ও বিতরণ করা হয় না। কারণ সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে কোন তেম কোন নির্দেশনা থাকে না। শিক্ষকরা ও প্রধান শিক্ষকও ব্যর্থ হন নিজ উদ্যোগে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে। কোন গাইডলাইন ছাড়া শিক্ষকরা বুঝতেও পারেন না যেসব ক্লাসে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রী যেমন গারো, হাজং এবং বাঙালিরা রয়েছে। মাতৃভাষায় এভাবে শিক্ষা দিয়ে বা গ্রহণ করে আদিবাসী শিশুদের প্রকৃতপক্ষে কী লাভ হচ্ছে এটা নিয়েও শিক্ষকরাও মতভিন্নতা প্রকাশ করেছেন।
এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য মাতৃভাষা ভিত্তিক ও বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষের শক্তি, শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজ, অভিজ্ঞ এনজিওগুলোর উচিৎ খুব যত্নসহ পদ্ধতি ও কৌশল গ্রহণ করা।