দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের অগ্রাধিকার পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের পরও মিলছে না সুফল। উল্টো কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। এরমধ্যে চিনি, ডাল, খেজুর, তেলসসহ আমিষ জাতীয় পণ্যের দাম যেন বেড়েই চলেছে। এমনকি আমদানি শুল্ক কমানোর ৩ সপ্তাহ পার হলেও এর কোন প্রভাব দেখা মিলছে না বাজারে।
বছরের এ সময়ে গতবছর যেখানে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা কেজি, সেখানে এবছর প্রতিকেজি পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ লেথকে ১২০ টাকা কেজি। ভারত থেকে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির খবরও দমাতে পারেনি এবারের পেঁয়াজের ঝাঁজ।
রমজানে যেসকল পণ্যের চাহিদা বাড়ে তার গতবছর এই সময়ের বাজার দরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় খেজুর বিক্রি হয়েছিল ১৮০ থেকে ৩৫০ টাকা প্রতিকেজি। এবছর সেই একই পণ্য বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৮৫০ টাকা। চিনি ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। সেই চিনি এবার বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। ছোলা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। এখন সেই ছোলার দাম ১১০টাকা প্রতিকেজি। এছাড়া, ব্রয়লার মুরগী (২১০), গরুর মাংস (৭৫০), খাসীর মাংস (১১০০), মুরগীর ডিম (৪৮) টাকা প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে চাল, রসুন, আদা, মুগ ডাল, অ্যাংকার ডাল, আলু, দারুচিনি ও এলাচেরও।
টিসিবির মূল্য তালিকায় দেখা যায়, শনিবার চিনি বিক্রি হয়েছে কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। গত ২৫ ফেব্রয়ারি দাম বৃদ্ধি পায় পণ্যটির। একমাস আগে চিনির দাম ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। তার এক বছর আগে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৯১ শতাংশ।
হাতিরপুল বাজারের আব্বাস মিয়া বলছেন: খোলা সাদা চিনি বিক্রি করছি কেজি ১৪৫ টাকা আর লাল চিনি ১৭০ টাকা। ২৬ ফেব্রুয়ারী পাইকারীতে এক বস্তা (৫০ কেজি) চিনি কিনেছি ৬৮০০ টাকা। গাড়িভাড়া ও লেবার মিলে আরও ৫০ টাকা পড়েছে। আপনি যদি ১ কেজি ২ কেজি মাপেন তাতে ঘাটতি আছে। সব মিলিয়ে আমাদের ১৩৮-১৩৯ টাকা পড়ে। আমরা ১৪৫ টাকা বিক্রি করছি।
পাইকারীতে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা ফ্রেসের চিনি বিক্রি করছি ৬৭৮০ টাকা।
শনিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ও মুদি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ১ মার্চ থেকে সয়াবিন তেল লিটারে দশ টাকা কমে বিক্রির কথা থাকলেও একটি-দুটি দোকান বাদে প্রায় সব জায়গাতেই আগের দামেই, অর্থাৎ ১৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন: দাম কমের তেল এখনও তাদের হাতে পৌছায়নি। তাই বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন তারা।
মাংসের পাশাপাশি দাম বেড়েছে মাছেরও। বাজারে এককেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকায়। এছাড়া চাষের তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, কৈ মাছ ২৫০ টাকা, শিং ৫৫০ টাকা।
৮ ফেব্রুয়ারি চারটি রোজার পণ্যের (চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর) শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ঘোষণায় অন্যান্য শুল্ক বহাল রেখে শুধু কাস্টমস ডিউটি টনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ (অপরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে) থেকে কমিয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে। পরিশোধিত চিনির কাস্টমস ডিউটি ৩ হাজার থেকে কমিয়ে ২ হাজার টাকা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর একই প্রক্রিয়ায় অপরিশোধিত চিনির কাস্টমস ডিউটি ৩ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে করা হয়েছিল ৩ হাজার টাকা।
রমজান মাস উপলক্ষে চার পণ্যে শুল্ক—মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ছাড় দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পাঁচটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের শুল্ক বিভিন্ন পর্যায়ে কমানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সেদ্ধ ও আতপ চালের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত এ সুবিধা পাবেন চাল আমদানিকারকরা।
স্থানীয় পর্যায়ে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তেলে এ দুই সুবিধা ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানিকারকরা ৩০ মার্চ পর্যন্ত এ সুবিধা পাবেন।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানিয়েছেন, রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজারে নিরবিচ্ছন্ন পণ্য সরবরাহ, বাজার মনিটরিসহ সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা করা যায়, সরকারের এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের ফলে আগামী রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তিনি বলেন, বাজারে নিরবিচ্ছন্ন পণ্য সরবরাহ করা গেলে কেউ আর কারসাজি ও মজুতদারি করে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে পারবে না। তখন পণ্যমূল্য একটা যৌক্তিক পর্যায়ে থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এ ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এ ছাড়া আসন্ন রমজান উপলক্ষে সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে এক কোটি প্রান্তিক পরিবারকে চাল, ডাল, তেল, খেজুরসহ ৫ ধরণের পণ্য সরবরাহ করবে। এতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে।