তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পকে এই দশকের সবচেয়ে প্রাণঘাতি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আর ভেঙে পড়েছে ৬ হাজারের বেশি ভবন। কী কারণে এতো ভয়াবহ ছিল এই ভূমিকম্প, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
ভূপৃষ্টের অভ্যন্তরে পূর্ব আনাতোলিয়ান এবং এরাবিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।
ভূত্বকের উপরিভাগ আলাদা আলাদা টেকটোনিক প্লেটের দ্বারা গঠিত। এই বিশাল টেকটোনিক প্লেটগুলোর মাঝে থাকা ফাটলকে ভূত্বকের ফল্টলাইন বলা হয়। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর আভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের শক্তি উৎপন্ন হওয়ার ফলে এই বিশাল টেকটোনিক প্লেটগুলো নড়তে থাকে। ফল্ট লাইনে একটা টেকটোনিক প্লেটের সাথে আরেকটা টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটে।
তাই দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফল্টলাইনের উপরিভাগে ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্পের প্রভাব তীব্র হয়। আর ভূমিকম্প সাধারণত এই ফল্টলাইনের আশপাশেই হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পবিদরা বলেছেন, তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অস্থিতিশীল এক ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলের আশপাশে। আর সেই অঞ্চলটিকে বলা হয়, পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। অ্যারাবিয়ান প্লেট ও আনাতোলিয়ান প্লেট এখানে এসে মিলিত হয়েছে। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টে এই দুই প্লেটের ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যে সংঘর্ষের ফলে তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটেছে।
বিবিসি বলছে, বিপজ্জনক এই ফল্ট তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর অবস্থিত। ভূমিকম্পবিদরা তুরস্কের ওই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে আগেই শনাক্ত করেছিলেন।
ভূপৃষ্ঠের নিচে কী ঘটেছিল এবং এরপরে আরও যা ঘটতে পারে, বিজ্ঞানীরা কী বলেছেন:
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কোথায়?
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল তুর্কি শহর নুরদাগি থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের ১৮ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পটির শক্তিশালী কম্পনগুলো উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে মধ্য-তুরস্ক এবং সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে।
বিংশ শতাব্দিতে পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টলাইনে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঘটনা সামান্যই দেখা যায়। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার গবেষণা সহযোগী রজার মুসন বলেন, ‘আমরা যদি সিসমোমিটার দিয়ে রেকর্ড করা (প্রধান) ভূমিকম্পগুলোর দিকে তাকাই তাহলে সাধারণ মাত্রার থেকে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা খুব কমই দেখা যাবে।’
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, এই অঞ্চলে ১৯৭০ সালের পর থেকে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওপরে মাত্র তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। তবে ১৮২২ সালে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে আনুমানিক ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।
ভূমিকম্পটি কতটা ভয়াবহ ছিল?
যেকোন বছরে ৭ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় গড়ে ২০টিরও কম। সেই হিসেবে সোমবারে তুরষ্কে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল অনেক বেশি প্রাণঘাতী।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান জোয়ানা ফাউর ওয়াকার বলেন, ২০১৬ সালে ইতালির মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যাতে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই তুলনায় আজ তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল ২৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে এতবেশি শক্তির ভূমিকম্প হয়েছিল মাত্র ২ বার।
কেন এত শক্তিশালী?
পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে একটি স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট হিসেবে মনে করা হয়। এই ফল্টে কঠিন শিলাযুক্ত প্লেটগুলো ফল্ট লাইনজুড়ে উল্লম্বভাবে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। শিলাযুক্ত প্লেট যতক্ষণ পর্যন্ত আনুভূমিক গতিতে পিছলে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে ঘর্ষণ চলতে থাকে। ফলে প্রবল বেগে সেখান থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়; যা ভূমিকম্পের সূত্রপাত ঘটায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সান আন্দ্রিয়াস ফল্টকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট হিসেবে ধরেন বিজ্ঞানীরা। এই ফল্টে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়কর এক ভূমিকম্প দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলটি ভূপৃষ্ঠের তুলনামূলক অগভীর অবস্থানে উৎপত্তি হয়েছে। ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী ডেভিড রথারি বলেন, ‘উৎসের গভীরতা কম হলে ভূমিকম্পে ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন বেশি তীব্র হয়।’
আফটারশক কেমন হতে পারে?
প্রাথমিক ভূমিকম্পের এগারো মিনিটের মাথায় তুরস্ক-সিরিয়ায় ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আফটারশক অনুভূত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর আবারো ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। পরে বিকেলের দিকে আবারও ৬ মাত্রার আফটারশক অনুভূত হয়।
মুসন বলেন, ‘আমরা এখন যা দেখছি তা হল পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টলাইনের সংঘর্ষ আশপাশের ফল্টেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা আশা করছি, এই ধরনের ভূমিকম্প আরও কিছু সময়ের জন্য দেখা দিতে পারে। ’
এর আগে ১৮২২ সালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পরের বছরও দেশটিতে আফটারশক অব্যাহত ছিল।
শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে?
এর আগে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষ মারা যায়।
রজার মুসন বলেন, তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে প্রাণহানি নেপালের তুলনায় কম হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক হাজারও হতে পারে। তীব্র শীতের আবহাওয়ার অর্থ হল, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।