জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘দ্য ট্রি অব পিস’ পুরস্কার পাওয়া নিয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস মিথ্যাচারে নেমেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যেই পুরস্কারকে ইউনেস্কো দিয়েছে বলে ড. ইউনুস দাবি করেছেন সেটি ইউনেস্কো প্রদত্ত নয় বরং একজন ইসরায়েলি শিল্পীর দেওয়া একটি স্মারক ‘দ্য ট্রি অব পিস’ । সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে একটি ফোরামের অনুষ্ঠানের ড. ইউনূসের হাতে এই রেপ্লিকা তুলে দেয়ার ঘটনার পর পুরস্কার নিয়ে মনগড়া তথ্যের প্রচারণা শুরু হয়। আর এতে বিস্মিত হয়েছে দেশের নাগরিক সমাজ।
‘দ্য ট্রি অব পিস’ হচ্ছে ইউনেস্কোর অফিসিয়াল ট্রফি। বিভিন্ন খাতে অসামান্য অবদান রাখায় গুণীজনদের এই পুরস্কার দেয় জতিসংঘের সংস্থাটি। এর আগে ২০১৪ সালে কন্যা শিশু ও নারী শিক্ষার উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই পুরস্কার তুলে দেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক নিজে।
ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক কূটনীতির শুভেচ্ছাদূত হলেন ইসরাইলের শিল্পী-ভাস্কর হেডভা সের। দ্য ট্রি অফ পিস হলো হেডভা সেরের একটি ভাস্কর্য। শিল্পকর্মটি বৈশিষ্ট্য হলো-গাছের ডালে আকাশের দিকে মুখ করে থাকা একটি পাখি, যা জাতিসংঘের শান্তির মূল্যবোধকে প্রকাশ করে। কিন্তু ইউনেস্কোর কোনো প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়াই শিল্পকর্মটির নির্মাতা যদি কোনো রেপ্লিকা কারো হাতে তুলে দেন, তাহলে তা কীভাবে সেটি ওই সংস্থার পুরস্কার হতে পারে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
আর এসব প্রশ্নের অবতারণার পেছনে রয়েছে খোদ ইউনূস সেন্টার। গত ২১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউনূস সেন্টার জানিয়েছে, একাদশ গ্লোবাল বাকু ফোরামে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ইউনেস্কোর ‘দ্য ট্রি অব পিস’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তির শিরোনাম দেয়া হয়, ‘বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে প্রফেসর ইউনূসের বিশেষ ভাষণ, ইউনেস্কো থেকে দি ট্রি অব পিস পুরস্কার গ্রহণ’। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এই খবর প্রকাশ করা হয়। মূলত গ্লোবাল বাকু ফোরামের সম্মেলনের একটি ঘটনা থেকেই ইউনূসের ট্রি অব পিস পুরস্কার পাওয়ার খবরটি ছড়ানো হয়।
ইউনুস সেন্টার জানায়, একাদশ গ্লোবাল বাকু সম্মেলনের শেষ দিনে প্রফেসর ইউনূসকে ইউনেস্কার ‘দি ট্রি অব পিস’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অনুষ্ঠানের সমাপনী নৈশ ভোজে তাঁর হাতে এই সম্মাননা তুলে দেয়া হয়।
পরে ইউনেস্কোর কাছে এ বিষয়ে জানতে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য।
ইউনেস্কোর নাম ব্যবহার করে প্রতারণা ও পরিকল্পিত মিথ্যাচার করায় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ইউনূস সেন্টারের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যা চাইবে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন। কমিশনের ভাষ্য, ‘বিষয়টি যেহেতু প্রতারণামূলক এবং পরিকল্পিত মিথ্যাচার, সেহেতু তাদের (ড. ইউনূস ও ইউনূস সেন্টার) বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার ব্যাখা চাওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন বলছে, ১১তম বাকু ফোরাম যেখানে এ সম্মাননা দেওয়ার সংবাদ প্রচার হয়েছে, সেখানে ইউনেসকোর কোনো অফিসিয়াল প্রতিনিধিত্বই ছিল না। অধিকন্তু ইউনূস সেন্টার কর্তৃক দাবিকৃত সম্মাননা ইউনেস্কোর কোনো পুরস্কার বা সম্মাননাও নয়। ড. ইউনূসকে ‘ট্রি অব পিস’ নামক একটি ভাস্কর্য স্মারক/সম্মাননা প্রদান করেন ইসরায়েলি ভাস্কর্যশিল্পী মিস হেদভা সের। মিজ হেদভা নিজে নিশ্চিত করেছেন যে, ড. ইউনূসকে ‘ট্রি অব পিস’ প্রদানে ইউনেসকোর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।’
ড. ইউনুসের এমন কাণ্ডে বিস্মিত হয়েছে সুশীল সমাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ইউনুস সেন্টারের আরও সচেতন থাকার প্রয়োজন ছিল। কারণ ড. ইউনূসকে নিয়ে এমনিতেই অনেক সমালোচনা আছে। এছাড়া তার প্রতি সবার একটি বাড়তি নজর থাকবেই। সেই হিসেবে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আসলে পুরস্কার কোথা থেকে কে দিয়েছে-সেটি পরিষ্কার করলেই হয়ে যেত। কিন্তু যেভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখন তো খুব সহজ এটাকে যাচাই করা। এখন ইউনেস্কো বলছে -এটি তাদের দেওয়া নয়, যিনি দিয়েছেন তিনিও বলেছেন এখানে ইউনেস্কোর সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের পত্রিকাগুলোকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। একটি প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে দিলে সেটি যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্য যে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, ‘আমাদের জাতিগতভাবে লজ্জায় পড়ে যেতে হয় যখন ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কেউ এরকম মিথ্যাচার করেন। ড. ইউনূস না বুঝে এরকম করে ফেলেছেন এটা ভাবার সুযোগ কম। কেননা তিনি সারাজীবনই বিভিন্ন পর্যায়ে তার উচ্চাকাঙ্খার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যে সংস্থার নাম পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে তাদের পক্ষ নিশ্চয় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’