দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবেন এমন একটা অংশের মানুষের ধারণা গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা অনেকটা এনজিও ঘরনার এবং প্রফেসর ইউনূসের সাথে যা হচ্ছে তা প্রতিহিংসামূলক! আসলেই কি ঘটনা তাই?
গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক। যার মালিক সরকার, ঋণ গ্রহীতা সাধারণ জনগণ । অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস গড়ে তুলেছেন নিয়ন্ত্রণাধীন ২৮টি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রামীণ ব্যাংক তথা সরকারের টাকায় হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে তিনি তার প্রতিষ্ঠান জবর দখল হয়েছে বলে দাবি করে বসলেন। জবর দখলের দাবি তোলা যে সাতটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এই আলোচনা, সেগুলো হলো: গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী ও গ্রামীণ শক্তি। সাতটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনুস।
অর্থনীতির অধ্যাপক ডক্টর ইউনূসের শান্তিতে নোবেল জয়ে পৃথিবীব্যাপী তার বিশাল সুখ্যাতি এবং প্রভাব আঁচ করতে না পারার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যখন সকল প্রটোকল ভেঙে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ চান তখন সেটি আরও স্পষ্ট হয়। তবে ইউনূস সাহেবর আইনের শাসনের প্রতি অনীহা ও বিদেশি হস্তক্ষেপে পার পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরিতে রাষ্ট্রের উদাসীনতা ছিল বিগত সময়ে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্যাংকের অর্থে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে দেয়া হয়েছে নিয়ম বহির্ভূত ও নজিরবিহীন ছাড়, ফলে মানুষের মনে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তৈরী হয়েছে, যা সত্য নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২-তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলতে আমরা বুঝি পার্লামেন্ট, সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা (স্ট্যাটুটরি পাবলিক অথরিটি)। যে সব সংস্থা, সংগঠন বা কোম্পানির কার্যাবলি অথবা প্রধান কার্যাবলি রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরি বিশেষ কোনও আইন, স্ট্যাটিউট বা অর্ডিন্যান্সের দ্বারা পরিচালিত হবে, সে সব প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও বলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সময়কার এক অর্ডিন্যান্সের বলে।
বাংলাদেশের সংবিধান মানলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করলে এটা সুস্পষ্টভাবে পরিষ্কার যে, সংবিধানের ১৫২ ধারা অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক রাষ্ট্রের একটি অংশ। কারণ এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সংস্থা। তার মানে, এটি একটি রাষ্ট্রীয় সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও অবশ্যই নয়। আপনি যদি ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্সটি পড়েন, দেখবেন এতে স্পষ্ট করে লিখা রয়েছে, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করতে পারে । কিন্তু একটা দীর্ঘ সময়ে নানান অনিয়ম সামনে আসলেও সরকারের উদাসীনতা ও ইউনূস সম্পর্কে অতিউচ্চ প্রচার প্রচারণার কারণে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ড. ইউনূসের বয়সসীমা অনেক আগেই পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি এ পদে ছিলেন।সরকার চাইলে তাকে আইনগত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ডিসমিসাল, টার্মিনেশন, ফোর্সড রিটায়ারমেন্ট, ডিমোশন টু আ লোয়ার পোস্ট ইত্যাদির মতো বড় কোনও শাস্তি দিতে পারতো, কিন্তু তা না করে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে শুধু জানিয়ে দেয় প্রফেসর ইউনূস আর এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পারিচালক নেই। প্রফেসর ইউনূস আইনের এই স্বাভাবিক বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেননি, তিনি এই সিদ্ধান্তকে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন । তার দাবি ছিল গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যার ৯৭ ভাগ শেয়ার গ্রামীণ হতদরিদ্র নারী এবং তিনি এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। উচ্চ আদালতের পূর্ণ বেঞ্চ একমত হয়ে প্রফেসর ইউনূসের দাবি খারিজ করে দেন এবং তাকে জানিয়ে দেন, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা নন। তাছাড়া তিনি অবশ্যই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক নয়। এ প্রতিষ্ঠানের এমডি’র পদবি অনান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি’র সমতুল্য।
যারা প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে অন্ধ আবেগে ভোগেন তাদের জানা উচিত প্রফেসর ইউনুস এবং তার প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের তদন্ত প্রথম করে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভশন। তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনম্যান তৈরী করেন ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে’ (Caught in Micro Debt) নামে এক প্রামাণ্য চলচিত্র। বিভিন্ন সময়ে দেশে বিদেশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে ইতিবাচক চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল এই চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ তার বিপরীত একটি চিত্র তুলে এনেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ভর্তুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯৯৬ সালে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের (নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি) দেওয়া অর্থ থেকে ১০ কোটি ডলারেরও বেশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণ নামে নিজের অন্য এক প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেন ইউনূস যা নিয়ম বহির্ভুত ও প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ।
প্রামাণ্য চিত্রটি তৈরির সময়ে এর নির্মাতা ৬ মাস ঘুরে এই সম্পর্কে ড. ইউনূসের বক্তব্য নিতে পারেনি, উপরন্তু প্রতিবেদনটি না প্রচারের জন্যে চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন প্রফেসর ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দাতা গোষ্ঠী অনুদান এবং ঋণ দেয় গ্রামীণ ব্যাংকে। অনুদানের সব অর্থ যদি রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে যায় তাহলে ড. ইউনূসের লাভ কী? তাই দাতাদের অনুদানের অর্থ দিয়ে গঠন করলেন সোশাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ)। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ঐ ফান্ড দিয়ে একটি আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৯৪ সালেই ‘গ্রামীণ ফান্ড’ নামের একটি লিমিটেড কোম্পানী গঠন করা হয়। তাতে ঐ ফান্ডের ৪৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিলো শুরু থেকেই।
মজার ব্যাপার হলো গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে এবং বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গঠিত হয়। এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছে তা সবই আইনত গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি থাকলেও, ২০২১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত ব্যক্তি। কিন্তু ড. মুহম্মদ ইউনূস এখনও গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।
গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের মাধ্যমে গঠিত ২৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একমাত্র গ্রামীণ টেলিকম ছাড়া আর সব প্রতিষ্ঠানই লোকসানী। গ্রামীণ টেলিকম দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল নেটওয়ার্ক। গ্রামীণ ফোনের ৩৪ দশমিক দুই শতাংশ শেয়ারের মালিক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০২২ সালে গ্রামীণ ফোন ট্যাক্স, ভ্যাট দেয়ার পর নীট মুনাফা করেছে তিন হাজার নয় কোটি ষোল লাখ টাকা। অর্থাৎ গ্রামীণ ফোন থেকে গ্রামীণ টেলিকম প্রতিবছর নীট মুনাফা পায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এই টাকায় প্রফেসর ইউনূস তৈরী করেছেন বিভিন্ন নাম সর্বস্ব কোম্পানি, যেগুলোর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাঁচারের অভিযোগ আছে।
গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি। এ ধরনের কোম্পানিকে বলা হয় নট ফর প্রফিট কোম্পানি। সুতরাং গ্রামীণ টেলিকম তার লভ্যাংশ কোথাও বিনোয়োগ করতে পারবে না, শুধু সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া। কিন্তু রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোন লিমিটেডসহ ১২ টি প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করেছে, যার প্রতিটি ব্যবসায়িক এবং এর ধারণকৃত ইকুইটির পরিমাণ ৪৬১.৭৭ কোটি টাকা। যেই গ্রামীণ টেলিকমই করা হয়েছে অন্য একটি সেবা খাতের টাকা আইনবহির্ভুত স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে, তারাই আবার তাদের লভ্যাংশ বিনিয়োগ করেছে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের মামলায় ড ইউনুসের পক্ষে থেকে বলা হয়েছে, গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেছে, যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম চুক্তিভিত্তিক, তাই তাদের নিয়োগও চুক্তিভিত্তিক। ২০২৩ সালের তরিকুল ইসলাম ও অন্যান্য বনাম গ্রামীণ টেলিকম ও অন্যান্য শীর্ষক ১৯০ নম্বর কোম্পানি মামলার হাইকোর্ট নথির ১১ নং পৃষ্ঠার প্রথম বাক্যেই বলা আছে, মামলা দায়েরকৃত ব্যক্তিবর্গ কোম্পানির স্থায়ী কর্মচারী হিসেবেই মামলাটি দায়ের করেছে। প্রফেসর ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম তাদের বক্তব্যে যে বলেছে, তারা কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে স্থায়ী করে না, বরং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়, এ দাবিটি মিথ্যা ও আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিমূলক।
শ্রমিক ঠকানোর জন্য তারা শ্রম আইন ২০০৬ এর চতুর্থ ধারার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এ আইন তারা মানেনি। একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। তৃতীয় শ্রম আদালতে ২০১৭ দায়েরকৃত মামলা নং ৫৪৫ ও ৫৫৭ থেকে দেখা যায়, দুই মামলার বাদী গ্রামীণ টেলিকমে চাকুরিরত ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও শহিদুল ইসলাম আদালতে অভিযোগ করে যে, তাদের পদবী স্থায়ী প্রকৃতির হলেও তাদের স্থায়ী করা হচ্ছে না; বরং চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির নামে তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এটা শ্রম আইনের চতুর্থ ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আমাদের অবশ্যই জানতে চাওয়া উচিত প্রফেসর ইউনূস দায়েরকৃত মামলায় অপরাধ না করলে কোর্টের বাইরে সমাধান করলো কেনো? গ্রামীণ টেলিকমের দেওয়া বক্তব্যের এই অংশে সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তিটি উল্লেখ করেছে তারা। বক্তব্যের অষ্টম পাতায় তারা বলছে, “শ্রম আদালত ও মহামান্য হাইকোর্টে কোম্পানি ম্যাটার্স ২৭১ অফ ২০২২ এর ০৪/০৪/২০২২ ইং তারিখের আদেশ ও নির্দেশনা দেখে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের মনে ভীষণ ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়। ২৮ ধারায় নট ফর প্রোফিট কোম্পানির মুনাফা বিতরণযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ টেলিকম অন্য উপায়ে শ্রমিক-কর্মচারী ও সিবিএর সাথে আদালতের বাইরে গ্রহণযোগ্য সমাধান করে।
প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে কিছুদিন আগে । গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ড. ইউনূস তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা ‘ইউনূস ট্রাস্টে’ দান করেন। এনবিআর এ সময় আইন অনুযায়ী তার কাছে ১৫ শতাংশ দানকর দাবি করে। ড. ইউনূস এই দানকর দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং এনবিআরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ৩১ মে তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলায় ড. ইউনূস হেরে যান। রায় মেনে নিয়ে ১২ কোটিরও বেশি টাকা তিনি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এনবিআরে জমা দেন।
প্রফেসর ইউনূস ও তার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন অনেকদিন থেকেই কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণেই হোক বা বিদেশি প্রভুদের ভয়েই হোক তাকে কোনো চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়নি দীর্ঘদিন। দেশের সমস্যা নিয়ে তিনি সবসময়ই নীরব। দেশের কোন সংকটে, উৎসবে তিনি থাকেন না। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে বিদেশে তিনি সরব। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। দারিদ্র জাদুঘরে যায়নি বটে, তবে তিনি অর্থ-বিত্ত বৈভবের জাদু দেখিয়েছেন নিয়ম বহির্ভুতভাবে এক প্রতিষ্ঠানের অর্থে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে। রাষ্ট্রের অর্থ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এ এক অদ্ভুত জালিয়াতি।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত কোম্পানি গঠন রাষ্ট্রের সাথে ভয়ংকর প্রতারণা। প্রফেসর ইউনূসের জন্যে যারা ব্যাথিত হচ্ছে তাদের কাছে অনুরোধ দয়া করে সত্য ও আইনের কথা বলুন, প্রয়োজন হলে জোবরা গ্রামে যান, গিয়ে দেখুন ক্ষুদ্র ঋণ আসলেই কতটুকু দারিদ্র বিমোচন করেছে। ক্ষুদ্র ঋণের বলি হয়ে আত্মহত্যা করা মানুষদের কথা বলুন। প্রফেসর ইউনূস তার নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামীণ ব্যাংক কতটা ভয়ঙ্কর ছিল তার একটা ছোট উদহারণ হচ্ছে রুস্তম মন্ডলের আত্মহত্যা।
১৯৯৮ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার পর সরকারের অনুরোধে দেশের প্রায় সব এনজিও তাদের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে কিস্তির টাকা প্রদানে শিথিলতা দেখিছিলো। ব্যাতিক্রম ছিল শুধু প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক। সে সময়ে সংসদে পয়েন্ট অফ অর্ডার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলেন সংসদ মির্জা আজম। বিপুল সমালোচনা হওয়ার পরেও সিদ্ধান্ত থেকে সরেনি ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক।
৯৮ এর আগস্ট থেকে ৯৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক কিস্তি আদায়ের জন্য সারা দেশে প্রায় ১৩ হাজার সার্টিফিকেট মামলা করে। এসব মামলায় অন্তত দুই শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাত্র পাঁচটি কিস্তি বাকি থাকায় ও ঋণ পরিশোধের অব্যাহত চাপে আত্মহত্যা করে যশোরের কৃষক রুস্তম ( দৈনিক সংবাদ ‘৯৮ )। আত্মহত্যার এমন অনেকগুলো ঘটনা ঘটলেও রুস্তমের বিষয়টি উল্লেখ করছি তার কারণ এই নিয়ে তখনকার অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পরিপ্রেক্ষিতে একটি পর্ব প্রচার হয়েছিল, মৃত রুস্তমের পরিবারের শেষ সম্বল থাকার ঘরের টিন খুলে নিয়ে গিয়েছিলো গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন। অসহায় রুস্তমের কন্যা-স্ত্রীর ঠাঁই হয়েছিল খোলা আকাশের নিচে, এতো নিষ্ঠুর ঘটনার পরেও তাদের মুক্তি দেয়নি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ, গণমাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত হওয়ার পরে বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূস বলেছিলেন, আইন সবার জন্যে সমান। তাহলে সেই আইনে এখন কেন ভরসা রাখতে পারছেন না প্রফেসর ইউনূস?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)