দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়াকে এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার অনন্য এক সুযোগ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেছেন, মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে যা কিছু করা সম্ভব তাই তিনি করবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মত সরকার গঠন করেছে। নতুন মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন সামন্ত লাল সেন। নতুন সরকারের সংসদ সদস্য না হয়েও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর আজ মঙ্গলবার মন্ত্রী হিসেবে তার একমাস পূর্ণ হচ্ছে।
আগুনে পোড়া ও নানানভাবে অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী গুণী এই চিকিৎসক পোড়া রোগীর চিকিৎসায় ছিলেন ভরসার এক নাম। নতুন সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের পর তাকে ঘিরে এদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ও নানাবিদ অগ্রগতি, সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতি কমবে বলেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ঠরাও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
গত ১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রীসভার সদস্যদের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর দেশের ইতিহাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দ্বিতীয়বারের মত একজন চিকিৎসককে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ১৪ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তার দফতরে যোগদান করেন। শুরু করেন এদেশের দ্বিতীয় চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। প্রথম দিন থেকেই তিনি বলে আসছেন তৃনমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাই তার কাজ হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে এক মাসের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, কেবল শুরু, এখনো বহুদূর যেতে হবে।
একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের কষ্ট ও দুভোর্গ সবই জানেন। ফলে তিনি মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে বরাবরই সংবেদনশীল। মন্ত্রী হিসেবে কোনো অগ্রাধিকার ঠিক করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো এই বিষয়ে তিনি কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করেননি তবে তার মূল লক্ষ্যে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে যা কিছু করা সম্ভব তাই তিনি করবেন। এখনো মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো দেখছেন, বুঝছেন এবং তার মতো করে পরবর্তীতে কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি মানুষের জন্য কাজ করার মনোবাসনা নিয়ে মন্ত্রীত্বের সময়গুলোতে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তিনি কাজ করে যাচ্ছেন তবে এখনই কোন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে চান না। মূলত আরও কিছুদিন সময় নিয়ে পুরো মন্ত্রণালয়কে বুঝে চিকিৎসা সেবার নিশ্চয়তায় কাজ করবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রথমবারের মত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন। সংসদে উত্থাপিত এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তির বিষয়টি তিনি জানেন। এই সংকট নিরসনে দ্রুতই উদ্যোগ নেওয়া হবে।
হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ‘ডিপ্লোমা ইন স্পেশালাইজড সার্জারি’ ডিগ্রি এবং পরে যুক্তরাজ্য ও জার্মানী থেকে সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর প্রবীণ এই চিকিৎসক গণমাধ্যমের কাছে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি মানুষের চিকিৎসায় কাজ করতে ভালোবাসেন। তবে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবেন এইটা তিনি কোনদিনই ভাবেননি।
এদেশে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে দেশের সবচেয়ে বড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথমবার একটি বার্ন ইউনিট চালু হয় ১৯৮৬ সালে। ডা. সামন্ত লাল সেন সেই তখন থেকে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় ভূমিকা রেখে চলেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারির জন্য স্বতন্ত্র একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের শয্যায় আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার নতুন এই উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন আজকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি বলেন, এদেশে মূলত শীতকালে আগুনের তাপ পোহাতে গিয়ে আগুনে দগ্ধ হওয়ার মত সাধারণ ঘটনা নিয়মিত ঘটে থাকে। তবে নগরায়নের কারণে বিভিন্ন সময়ে বাসাবাড়িতে গ্যাসের দুর্ঘটনার মত নানান দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে রাজধানীর পুরাতন ঢাকায় নিমতলির মত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আলোড়িত হয় পুরো দেশ। সাথে যুক্ত হয়ে একের পর এক রাজধানীর পুরান ঢাকাতে রাসায়নিক গুদামে আগুনের ঘটনা। পাশাপাশি, ঢাকার একাধিক বহুতল ভবনে আগুনের ঘটনায় পোড়া রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সমানে আসে। পরবর্তীতে হরতাল, অবরোধের নামে রাজনৈতিক সহিংসতায় শুরু হয় নতুন আরেক ধরনের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা। ওই সময় আগুন সন্ত্রাসের নামে চলন্ত বাস-যানবাহনে ছোঁড়া পেট্রল বোমায় মানুষের দগ্ধ হওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষদের অসহায় করে তোলে। পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত ও আলাদা হাসপাতাল নির্মাণের বাস্তবতা সামনে আসে।
ওই সময়ে আজকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনসহ সংশ্লিষ্টরা ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে এমনকি নিজস্ব যোগাযোগে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির জন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবার উপকরণ ও তহবিল যোগানে ভূমিকা রাখেন। ওই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর উপস্থিতি দেখা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে।
সবমিলিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয়ভাবে পোড়া রোগীর চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল করার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনকে সারাদেশের বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বড় মেডিকেল কলেজসহ জেলা পর্যায়ে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় আরও অধীকতর সুযোগ এবং উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসার জন্য জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ঢাকার বাহিরে চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।