বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার আরেক নাম মধুসূদন। ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে নানারকম কুসংস্কার নির্বিচারে চলছিল। বহুবিবাহ,সতীদাহ, জাতিভেদের মত নানা সামাজিক সমস্যা ভারতের সমাজ জীবনের প্রাণরস শুষে নিচ্ছিল। এসময় নতুন চিন্তা ও সমাজ সংস্কারে এগিয়ে আসেন রামমোহন রায়। কিন্তু সাহিত্য জগতে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আরও পরে। মধুসূদনই প্রথম মানবিকতার মন্ত্র শোনান সাহিত্যে। পরবর্তীতে বাংলা কাব্যকে নতুন পথে চলতে সংকোচ করতে হয়নি।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৯ বছর। মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন ‘অশনি-নিনাদের’ মতো। সনেট, ব্ল্যাংক ভার্স, মহাকাব্য, ও নতুন ধরনের নাটক-প্রহসন লিখে তিনি সেসময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কতটা মহিমামণ্ডিত করেছিলেন তা উপলব্ধি করতে আমাদের এতটুকু অসুবিধা হয় না। বস্তুত ভাষা ও ভাবরাজ্যে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই যুবক।
বাংলা সাহিত্যে তখনও চলছিল মধ্যযুগের মন্থর গতি, গতানুগতিক ধারা। মাইকেল মধুসূদন মধ্যযুগের এই মন্থর গতির জীবনধারার ছন্দকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। তার সাহিত্য সাধনার কাল মাত্র কয়েকটি বছর। এই স্বল্পপরিসর সৃষ্টিকালেও নিজেকে বৈচিত্র্য আর বৈভবে উজার করে দিয়েছিলেন। তিনি শুধু পয়ারকে ভাঙ্গেননি,বাংলা ভাষার প্রতি নতুন মমত্ববোধ জাগিয়েছিলেন বৈচিত্র্যময় রচনার মধ্যে দিয়ে।
বাংলা ভাষায় যে বিশ্বসাহিত্যতূল্য সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব তা তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন। ইউরোপের যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি তার অধিগত ছিল তার সঙ্গে বাঙালিকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এটি মাতৃভূমির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। ‘মণিজালে পূর্ণ’ বাংলা ভাষায় তিনি খনির সন্ধান পেয়েছিলেন। তাই মাতৃভাষা স্বরস্বতীর আরাধনায় একে একে অবদান রেখে যান অনাস্বাদিতপূর্ব সব অবদান।
মধুসূদনের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার সৃষ্টিশীল প্রয়াসের প্রথমে বলতে হয় অমিত্রাক্ষর ছন্দের কথা। পয়ারকে ভেঙে তিনি অমিত্রাক্ষরের অবতারণা করে নতুন কালের উপযোগী করে গতিশীলতার শক্তিতে সাজিয়েছেন। পয়ারের গতানুগতিকতায় তিনি দেখেছেন মধ্যযুগের ক্ষয়িষ্ণু জীবন। অমিত্রাক্ষরের মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন উদীয়মান নবীন ও গতিশীলতাকে। মধুসূদন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ‘প্রমীলা’ তাই তার কাব্যে বিদ্রোহী নায়িকা। অন্যান্য নারী চরিত্রের প্রতিও তিনি সহৃদয় ও সশ্রদ্ধ ছিলেন। এর কারণ নবলব্ধ শিক্ষা ও জীবনাদর্শ।
শিক্ষা ও জীবনাদর্শ তাকে নারী সমাজের প্রতি সশ্রদ্ধ ও সহৃদয় হতে শিখিয়েছিল। বীরাঙ্গনা কাব্যের ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ রয়েছে। ‘ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ‘ এবং একেই কি বলে সভ্যতা ‘ এই প্রহসন দুইটির বিষয়ও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ‘ কিংবা ‘একেই কি বলে সভ্যতা? ‘-এই রচনাগুলোতে তিনি তৎকালীন সমাজের মুখোশধারী মানুষকে কড়া চাবুক মেরেছিলেন। সেই সময়ে তিনি যাদের কথা বলেছেন সে চিত্র আধুনিক কালের অনেক চিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।
ইংরেজের সবকিছুর প্রতি তার উচ্ছ্বসিত আবেগ ছিল, মোহ ছিল। তাই বলে স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তার বিতৃষ্ণা বা অনীহা ছিল না। তিনি বিদ্রোহী ছিলেন স্বদেশ ও স্বজাতির মধ্যযুগীয় সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। তার সৃষ্টিকর্মে ছিল দেশীয়বোধ ও স্বদেশের প্রতি অনুরাগ। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘নীলদর্পণ’নাটক। স্বদেশের প্রতি অনুরাগী ছিলেন বলে ‘নীলদর্পণ’ নাটক তিনি অনুবাদ করতে পেরেছিলেন। নাটকটিতে শৈল্পিক দূর্বলতা ছিল। কিন্তু সেটা তার কাছে বড় হয়ে ধরা দেয়নি। স্বদেশ চেতনায় তিনি নাটকটি অনুবাদ করেন।
মধুসূদনের স্বল্পপরিসর জীবন একটা নাটক বিশেষ। সে জীবনে রয়েছে অনেক বেদনা, বঞ্চনা, হতাশা, উত্তেজনা আর না পাওয়া।তার জীবনে রোমান্টিক নায়কোচিত নানা উপাদান ছিল। অসাধারণ প্রতিভাধর পুরুষ মাইকেল ছিলেন বেপরোয়া, খামখেয়ালি। স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করতেন। অমিতব্যয়ী এই মানুষটি ভালোবাসার জন্য যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। অসম্ভব শক্তিসম্পন্ন মানুষটি বাংলা সাহিত্যকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একাই। ফ্ল্যামবোয়ান্ট লাইফস্টাইল তার পছন্দ ছিল।ছোট মাপের কোনকিছু তার ভালো লাগতো না। রাজার মত বাঁচতে চাইতেন। মধুসূদন ছিলেন ইংরেজদের প্রতি ভারতীয় জবাব।তারমধ্যে পাণ্ডিত্য, রোমান্টিকতা, স্বাজাত্যাভিমান এবং ইংরেজ মেজাজের অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছিল। তার রাজছত্র, রাজত্ব কিছুই ছিলনা। তবু বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন রাজা। আজ এই প্রবাদ পুরুষের ২০০তম জন্মদিন। মাইকেল মধুসূদনের দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে জানাই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)