দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর সরকার গঠনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন দেশের সচেতন মহল। সরকার গঠনের পর বিশেষজ্ঞদের বুঝতে বাকি থাকলো না এর গঠনকালে বেশ পর্যালোচনাও করেছে দলটির নীতি নির্ধারকরা। নতুন সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে সবার চোখ ছিল বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে। কারণ, টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করতে যাওয়া দলটির প্রধান বারবার ঘোষণা দিয়েও যেন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
অবশেষ গত ১১ জানুয়ারি প্রকাশ্যে আসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রীর নাম। আর এতে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই মন্ত্রণালয়ের জন্য এমন এক ব্যক্তিত্বকে বেঁচে নিয়েছেন, যার কর্মজীবনই শুরু হয়েছে বাণিজ্য দিয়ে। যাকে দেশের পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর এখন পর্যন্ত দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থার কারণ। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, তার কথার প্রতিফলন হলে দেশের বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ নেওয়ার পর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ১৪ জানুয়ারি রোববার দুপুরে সচিবালয়ে বলেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে নয়, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বাজার মনিটরিং নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হবে স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনা। অর্থ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নিয়ে দল গঠনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাপনা করা হবে।
১৪ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নয়, আমরা কাজ করব জনস্বার্থে, ভোক্তার স্বার্থে। সিন্ডিকেট শব্দ ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত নই। তবে আপনারা যাদের ‘বিগ ফিশ’ বলে থাকেন, সেই রকম সিন্ডিকেট এখানে থাকতে পারবে না।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সেই দিন আরও বলেছিলেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ব্যবসায়ীরা মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো কিছু উৎপাদন করে না। ভোক্তা যাতে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা পান, সেটা নিশ্চিত করা আমাদের কাজ। আমাদের দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা। আর উৎপাদক বা আমদানিকারক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চাই। মানিকগঞ্জ থেকে রাতে আসা ফুলকপি দুপুরের মধ্যেই যেন গৃহিণীদের কাছে পৌঁছে। সরবরাহ যদি ভালো থাকে, তাহলে কেউ বাজারে কারসাজি করার সুযোগ পাবে না, বেশি দামে পণ্য বিক্রি করারও সুযোগ পাবে না।
এর মাত্র চার দিন পর ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাজধানীর তাজমহল রোডে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) এক প্রোগ্রামে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা সৎভাবে ব্যবসা করবে, তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে। তবে যারা মজুতদারি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধির চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে সরকার একটুও পিছপা হবে না।
টিসিবির কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করা হবে বলে জানিয়ে সেই দিন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা টিসিবির কার্যক্রমকে ট্রাক থেকে দোকান (ডিলারের) পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এখন এই কার্যক্রম যেন ন্যায্যমূল্যের দোকানের মতো হয়, সেই জন্য কাজ করব। প্রধানমন্ত্রী তৈরি পোশাক ও অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের টিসিবির কার্যক্রমের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আলোকে শ্রমিকদের জন্য আলাদা কার্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বর্তমান এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ২০ লাখের স্মার্ট কার্ড তৈরি হয়ে গেছে।
স্বাধীনতার মাত্র ২ বছর আগে অর্থ্যাৎ ১৯৬৯ সালের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার নয়াপারা গ্রামের মকবুল হোসেন ও গোলাম ফাতেমা তাহেরা খানমের ঘর আলোকিত করে আসে ফুটফটে এক পুত্র সন্তান। যার জন্মের মাত্র দেড় বছরের মাথায় জন্ম লাভ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে লাল সবুজের এক টুকরো স্থান। যার জন্মের পর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে আমার এই সোনার বাংলা, নির্যাতন কিংবা অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলার মানুষ। সেই মানুষটার হাত ধরে পুনরায় মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় স্বাধীন বাংলার লক্ষ কোটি মানুষ।
টানা চার বার এবং মোট পাঁচবারের সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার ঘোষণা দিলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যেন সম্ভব হয়ে উঠছে না। সিন্ডেকেট, চাঁদাবাজি আর কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বে অবহেলার কারণে যেন বন্ধ করা যাচ্ছে না নিত্যপণ্যের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠনের সময় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী ভরসা করেছেন আহসানুল ইসলাম টিটুর ওপর। শপথ গ্রহণের পর থেকে নিয়মিত আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী। দেশের মানুষ তার কথার প্রতিফলনের অপেক্ষায়।
বিবিএ, এমবিএ শেষ করে কর্মজীবন শুরু হয় ব্যবসা দিয়ে। ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন কয়েকটি ব্যবসায়িক সংস্থাকেও। সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যপদ লাভ করেন আহসানুল ইসলাম টিটু। ১৯৯৫ সালে তিনি মনা ফিন্যান্সিয়াল কনসালটেন্সি অ্যান্ড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি সন্ধানী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৭ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৫ জুন তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়ও তিনি বাংলাদেশ বীমা সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের বাণিজ্য এমন এক ব্যক্তির হাতে সোপার্দ করেছেন, যিনি জন্মলগ্ন থেকে ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। আর তাইতো সচেতন মহলসহ সাধারণ মানুষও তার প্রতিটি শব্দের প্রতিফলন দেখার অপেক্ষায়। আগের যেকোন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে তার ওপর বেশি ভরসা রাখতে পছন্দ করছেন।
আহসানুল ইসলাম টিটুর কর্মজীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক অধ্যায়ও বেশ সম্প্রসারিত। পারিবারিকভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত এই ব্যক্তিত্ব। তার বাবা হাজি মকবুল হোসেন ঢাকা-৯ আসন থেকে ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক।
পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এই ব্যক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়াও আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল জেলা শাখার শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি টাঙ্গাইল-৬ আসন থেকে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এবং ২০২৪ সালে একই দল হতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তার সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভার তার হাতে অর্পণ করেন।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, আমি প্রথমেই নাগরপুর-দেলদুয়ার এর জনগণের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আমার জীবনের ব্রত। প্রধানমন্ত্রী যখন একটা দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি চেষ্টা করবো আমার সেরাটা দিতে।
এরই মধ্যে তার কাজ, পরিকল্পনা এবং চেষ্টার কথা উঠে আসছে বিভিন্ন মহলে। ২৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেই লক্ষ্যে সরকার প্রতিনিয়ত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ আহসানুল ইসলাম টিটু তার কর্মজীবন কিংবা রাজনৈতিক অধ্যায়ে যেমন সফল হয়েছেন, একইভাবে প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফল হবেন বলে বিশ্বাস করেন দেশের সচেতন মহল।