শীত শেষে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাফের তোমায় ভালবাসলাম বলে’- কবিতার মত প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। এমনি এক বসন্তের শুরুতেই প্রতিষ্ঠা হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি)। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি ফিরে পায় নতুন রূপ, নতুন প্রাণ। বসন্তের চলে যাবার শেষ দিনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিলোরোডের পাশে মেহগনি গাছে ঝুলে থাকা ফুটন্ত অর্কিড মন কাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের।
‘অর্কিড’ শুনলেই প্রকৃতির নিজস্বরীতির এক আভিজাত্যের কথা মনে আসে। গাছের ডালে শরীদ দুলানো ফুল। তবে এই ফুল সেই গাছের না, সে ফুল অন্য প্রজাতির। তবে জাতপাত যাই থাক, তারা গা জড়াজড়ি করেই থাকে, একসাথে বাঁচে। যতদিন গাছ আছে, সেই ফুলও আছে। অর্কিডের এ বাঁধন যেন বন্ধুত্বের, প্রাণের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিলোরোডের রাস্তার দু-পাশের গাছে গাছে নতুন পাতারা যেন সবুজ ছাউনি মেলে ধরে আছে। কিছু গাছের মগডালে অর্ধমৃত পরগাছার দেখা পাওয়া যায়। এগুলো দেখলেই বোঝা যায় গত শীতের শুষ্কতায় এমন অবস্থা। কিলোরোডের শেষ প্রান্তে এই অর্ধমৃত অর্কিডেই ফুল ফুটেছে। মৃদু বাতাসে সার্বক্ষণিক হালকা দোল খাওয়া অর্কিডের সৌন্দর্য যে কারও নজর কাড়ছে।
শুধু কিলোরোডেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনের প্রবেশমুখে একটি জারুল গাছে ফুটে উঠে সিঙ্গাপুরী অর্কিড। ছাত্রহল থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসে আসতেই হালকা লাল আর গোলাপের সংমিশ্রণের এই অর্কিডের দেখা মেলে।
জানা যায়, অসমীয়া এবং বাংলা ভাষায় একে কপৌ ফুল বলে। এটি অর্কিডেসি নামক অর্কিড পরিবারের সদস্য। এমন ফুটন্ত অর্কিড বন-জঙ্গলে সহজেই পাওয়া যায়। শীত এবং বসন্তের শুরুতে এই ফুল ফোটে। বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন অর্কিডের মধ্যে সহজলভ্য অর্কিড এটি এবং দেখতে খুবই সুন্দর।
এদের পাতা খাদাল, লম্বা, বায়ুমূল পুরুষ্টু ও ছড়ানো। পাতার কক্ষ থেকে ২৫-৩৫ সেমি লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরিতে ঠাসা ফুল থাকে। ফুল বেগুনি-সাদা এবং সামান্য সুগন্ধি থাকে। এই অর্কিড সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩শ মিটার উচ্চতায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বেনিন, বার্মা, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম এই অঞ্চলসমূহে এই পরাশ্রয়ী উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। এটি গাছের জন্য ক্ষতিকারক নয়। এই পরাশ্রয়ী অর্কিডই ভারতের আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশের প্রধান ফুল। আসামে এটি ভালোবাসা, প্রাচুর্য, এবং আমোদের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এজন্য এর পুষ্পবিন্যাস আসামের ঐতিহ্যবাহী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কিলোরোডে অর্কিডের এমন বাহারি সৌন্দর্য দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রোমেল আহমেদ বলেন, অর্কিড শীতলতম অঞ্চল ছাড়া গোটা বিশ্বে বিস্তৃত, তবে আর্দ্র-ক্রান্তীয় এলাকায়ই অধিক। আনুমানিক ২০০ বছর আগে থেকে অর্কিডের চাষ শুরু হয়েছে এবং ইউরোপিয়ানরাই প্রথম জঙ্গলের অর্কিডকে বাগানে যত্নের সঙ্গে চাষ করে আলোড়ন তৈরি করেছেন। আমাদের ক্যাম্পাসে সেভাবে অর্কিড বেড়ে উঠে না। যেহেতু এটি পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ- তাই কিলোরোডের পাশে, সেন্ট্রাল অডিটরিয়ামের সড়কের প্রবেশ মুখে এসবের দেখা মেলে। গাছের আবডালে এর অবস্থান হওয়ায় আমরা সেভাবে তাদের যত্ন নিতে পারি না। তবে কেউ যেন ফুল না ছিঁড়ে সে দিকে নিরাপত্তাকর্মী ও আমাদের ভূ-সম্পদ বিভাগের লোকদের নজর রাখা আছে। দেখুন, সত্যিই স্রষ্টা কত নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন এই ফুলগুলোকে! একটি ফুলের রং-রূপের সঙ্গে কোনো মিল নেই অন্যটির। অর্কিডের এ সৌন্দর্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে মুগ্ধ করছে।