চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

ঘোড়ার নাম ‘পারলে ঠেকাও’

বগুড়া সদর উপজেলা থেকে এসেছেন আজগর আলী। তার ঘোড়া অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছোটে। এজন্য ঘোড়ার নাম দিয়েছেন ‘পারলে ঠেকাও’। তার ঘোড়ার দাম এক লাখ টাকা। ৮০ হাজার টাকা হলে ঘোড়াটি বিক্রি করবেন বলে জানালেন তিনি। শুরুতেই জমে উঠেছে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী চেরাডাঙ্গী মেলায় ঘোড়ার হাট। ঘোড়সওয়ারি ও ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় জমজমাট হাট।

রাস্তার রাজা, বিজলী রানী, রাস্তার পাগল, কিরণমালা, রানী, সুইটি, রংবাজ, পারলে ঠেকাও, কাজলি, তাজিয়া, কুমার রাজা, বাহাদুর এমন বাহারি সব নামের ঘোড়া এখন এ মেলায় । ওদের ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায়ও মেলে নামের স্বার্থকতা। ঘোড়াগুলোর দুলকি চলনে বিদ্যুৎগতি, চোখের পলকে যেনো মাইল পার-এমন নানামুখী গুণের কারণে ঘোড়াগুলোর কদরও যথেষ্ট। পছন্দের ঘোড়া পেতে ক্রেতাদের মধ্যেও চলছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় এসেছেন ঘোড়া ব্যবসায়ীরা।

Bkash July

ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, আগেও তাদের বাপ-দাদারা এ মেলায় ঘোড়া কেনাবেচা করতেন, পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারাও ঘোড়া কেনাবেচা করছেন।

আয়োজকদের মতে, দেশের অন্যতম ঘোড়া বেচাকেনার হাট এটি। এ কারণে সারা দেশ থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন। প্রতি বছর ২৩ মাঘ মেলার উদ্বোধন হলেও এবার মেলা শুরু হয়েছে দুই দিন আগে, অর্থাৎ ২১ মাঘ। মূল মেলা এক মাস হলেও পশুর মেলা হয় ১৫ দিন। প্রথমে এক সপ্তাহ চলে ঘোড়ার হাট। এছাড়াও মেলা শুরু দু’তিন দিনের মধ্যে মহিষ, গরু, ভেড়া ও ছাগল কেনাবেচা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় এখন মুখর ঐতিহ্যবাহী চেরাডাঙ্গী মেলার ঘোড়ার হাট। দরদাম ঠিকঠাকের পর একটি খেলার মাঠে ঘোড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ক্রেতাকে দেখানো হয় ঘোড়ার দৌড়।

Reneta June

গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলা থেকে মো. আব্দুল জলিল প্রামাণিক এবার মেলায় ৩টি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন। তার ঘোড়ার নাম রাস্তার রাজা, বিজলী রানী ও রাস্তার পাগল। তিনটি অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন। একেকটি ঘোড়ার দাম হাঁকছেন দেড় লাখ টাকা। কাঙ্ক্ষিত দাম না বলায় তিনি ঘোড়া বিক্রি করতে পারেননি।

নীলফামারী জেলার জলঢাকা থেকে ‘কুমার রাজা’ নামের লাখ টাকা মূল্যের একটি ঘোড়া বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন মোসাদ্দেক। বিক্রি হলে ছোট ঘোড়া কিনবেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত তিনি।

 

জনশ্রুতি আছে, শত বছর আগে শুরু হওয়া এই মেলায় আগে গরু, ছাগল, ঘোড়া, মহিষসহ উট ও দুম্বার ব্যাপক আমদানি হতো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কালের বিবর্তনে ওইসব প্রাণীর পরিবর্তে জায়গা করে নেয় গরু, মহিষ এবং ঘোড়া। এছাড়া বিনোদনের জন্য যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ এবং সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র কাঠ, স্টিল ও প্লাস্টিকের ফার্নিচার, মিষ্টান্ন, মসলা, জুতা ও কাপড়সহ এমন কোনো জিনিস নেই যা এ মেলায় বিক্রি হয় না। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বর্গাকার এ মেলা ঘিরে এলাকার প্রায় ২০ গ্রামে চলে মেজবান আয়োজনও।

সবচেয়ে পরে বসে কাঠ ও স্টিলের ফার্নিচারের দোকান। গ্রামের মানুষরা এই মেলা থেকে মেয়ে জামাই এর জন্য ফার্নিচার, পুরো বছরের জন্য মসলাপাতি, কাপড় এবং সংসারের যাবতীয় জিনিষপত্র সংগ্রহ করেন।

দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার শান্তির বাজার থেকে ঘোড়া নিয়ে মেলায় এসেছেন নুর ইসলাম।তিনি জানান, ‘গত বছর তার ঘোড়ার নাম দিয়েছিলেন ‘কিরণ মালা’। সেটি মহিলা ঘোড়া ছিল। এবার পুরুষ ঘোড়ার নাম দিয়েছেন ‘রংবাজ।’ ৮০ হাজার টাকা পেলে রংবাজকে বিক্রি করে নতুন ঘোড়া কিনবেন বলে জানান।’

দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার তেঘরা জুলিমুদি খানা থেকে দু’টি ঘোড়া মেলায় এনেছেন মোহাম্মদ ইসলাম। তার ঘোড়ার নাম ‘বিজলী’ ও ‘কাজলী।’ একেকটি ঘোড়ার দাম হাঁকছেন এক লাখ ৮০ হাজার টাকা করে।

নাটোর জেলা থেকে আসা ক্রেতা মসলেহ উদ্দিন একটি ঘোড়া ৭০ হাজার বলেছেন।কিন্তু বিক্রেতা ইসলাম সোয়া লাখ টাকা দাম চাইছেন। শেষ না দেখে বিক্রি করবেন না জানিয়ে ইসলাম বলেন, ১০ বছর ধরে এ মেলায় ঘোড়া কেনাবেচা করছি। কিন্তু ঘোড়ার দৌঁড়ের মাঠ না থাকায় খুব সমস্যা হয়। ঘোড়দৌড় ঠিকমতো দেখানো না গেলে বিক্রি করা যায় না।

স্থানীয় আউলিয়াপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন,‘ এ অঞ্চলে এত পুরাতন মেলা আর কোথাও নেই। কালের বিবর্তনে আগের চেয়ে মেলার অবয়ব ছোট হলেও এখনও এই মেলার কারণে এলাকার আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। মেয়ে জামাই থেকে শুরু করে এমন কোনও আত্মীয় নেই, যারা মেলার সময় বেড়াতে আসেন না। মেলায় পুলিশ প্রশাসন ছাড়াও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে।

দিনাজপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভিরুল ইসলাম জানান, ‘মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে বিশেষ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। মেলায় আগত বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী, ক্রেতা- বিক্রেতার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি আনসার মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক নজর রাখা হবে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ মেলার ঐতিহ্য ফেরাতে যেন কোনো প্রকার অনিয়ম না থাকে, সে ব্যাপারেও তাদের নজরদারি রয়েছে।’

মেলা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান জানান,  ‘শত বছরের পুরনো এ মেলা শুরু থেকেই ঘোড়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার আগে এ মেলায় নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আসত। প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটিও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। এত বড় মেলা উত্তরবঙ্গের কোথাও নেই। মেলাকে ঘিরে আশপাশে বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। নানা আকৃতির হরেক রকম ঘোড়ার দেখা মিলছে মেলায়। গত দুই বছর করোনায় মেলা না হলেও এবার ভালো বেচাকেনার আশা ব্যবসায়ীদের।’

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View