ইতিহাসের পাঠ থেকে যতদূর জানা যায়, থমাস হারবার্ট লুইনের স্মৃতিকথা ‘আ ফ্লাই অন দ্যা হুইল’- এ বর্ণনা করেন, ১৭৬১ সাল থেকে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন জারির পর যে অঞ্চলটা শাসনযোগ্য ছিল, তার বাইরে বিরাট একটা এলাকা ব্রিটিশদের আওতার বাইরে থেকে যায়। চট্টগ্রামের পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন পার্বত্য জাতির স্বাধীন বসবাস ছিল। মোগল আমলে সীমিত নিয়ন্ত্রণ ছিল পার্বত্য অঞ্চলের কিছু এলাকায়।
তখন অধিকাংশ এলাকা ছিল নিজস্ব গোত্রশাসিত। পার্বত্য এলাকায় চাষাবাদের জমি ছিল খুব কম। আবাদি জমির পরিমাণ কম থাকায় খাজনার অংকটা তেমন লোভনীয় ছিল না। তাছাড়া দুর্গম অঞ্চল বিবেচনায় ওই অঞ্চল নিয়ে শাসকপক্ষের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না।
তখনো সরকারিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানা নির্ধারণ হয়নি। চাকমা, মারমা, মুরং, খুমিসহ আরও বেশকিছু পার্বত্য জাতিগোষ্ঠী ব্রিটিশ অধিকৃত এলাকায় বসবাস করত। এর বাইরে আরও পূর্ব দিকে দুর্গম এলাকায় কিছু জাতি ছিল, যারা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সেন্দু, সাইলু, হাওলং নামের উদ্ধত এবং স্বাধীনচেতা ওই গোত্রগুলো প্রায়ই হামলা চালাতো ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে। সেই পার্বত্য জাতিগুলোকে বাঙালিরা সাধারণভাবে কুকি নামে ডাকত। কুকিরা সমভূমির বাসিন্দাদের কাছে ছিল কিছুটা ভয়ের। তাদের হামলা থেকে পাহাড়ি বাঙালি শ্বেতাঙ্গ কেউ বাদ যায় নি। ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকায় বসবাসকারী পার্বত্য জাতিগোষ্ঠীগুলোও তাদের হাত থেকে রেহাই পায় নি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, স্বাধীনচেতা কুকিরা ঐতিহাসিকভাবে দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া।
ব্রিটিশ শাসনামলে অধিকাংশ বাঙালিরা ধারনা করতো, ওই পার্বত্যভূমিতে যারা বাস করে তারা হিংস্র, বর্বর, অসভ্য। সাপ-ব্যাঙ-কীটপতঙ্গ থেকে শেয়াল-কুকুর-হাতি-অজগর হেন কিছু নাই ওরা খায় না। কোনো কোনো জাতি জ্যান্ত মানুষও কাঁচা খেয়ে ফেলে! মোদ্দা কথা পূর্বদিকের ওই দুর্গম পার্বত্য এলাকা হলো সমতলের মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। মনে করা হতো ওই অঞ্চলে প্রবেশ করলে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা কঠিন কাজ। যা ছিলো বিচিত্র অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক গুজবে ভরপুর।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিলো গভীর জঙ্গলাবৃত অঞ্চল। ওই ভূখণ্ডে নাকি সমতলের মানুষের প্রবেশ নিষেধ। উনিশ শতকে নিজের প্রাণ বাজি রেখে সেই ‘নিষিদ্ধ’ দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন এক ব্রিটিশ অফিসার, থমাস হারবার্ট লুইন। দুঃসাহসী অভিযানে উন্মোচন হতে থাকে একের পর এক বিস্ময়। তথাকথিত ‘সভ্যতা’ হানা দেয় পাহাড়ে, বাইরের দুনিয়ায় প্রথমবারের মতো পা ফেলে অচিন অঞ্চলের মানুষ।
ক্যাপ্টেন লুইনের পার্বত্য অভিযান ছিল স্বতঃপ্রণোদিত। যে পথে আগে কোনো ইউরোপিয়ানের পা পড়েনি, সেই পথ আবিষ্কারের এক অদম্য নেশায় তিনি চট্টগ্রামের তার নিজের শাসনাধীন সীমানা ছাড়িয়ে অজানা পথে চলতে শুরু করেন। মাত্র দুজন দেশি কর্মচারী সাথে নিয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ সেই অভিযাত্রার প্রাথমিক ফলাফল ছিল তার জন্য প্রাণঘাতী। যদিও চূড়ান্ত ফলাফলে ব্রিটিশ শাসনের সীমানা সম্প্রসারণ হয়েছিল বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে।
তিনি দক্ষিণে বান্দরবানের পাহাড় জঙ্গলাকীর্ণ পথ কেটে, পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে কালাদান নদীর তীরে এক নিষিদ্ধ অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে যান। সেখানে বাস করত দুর্ধর্ষ সেন্দু জাতি। যাদের ভয়ে চট্টগ্রামের অন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলো তটস্থ থাকে। সেন্দু এলাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে তিনি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে বসেছিলেন। বিচিত্র ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বহুকষ্টে তিনি প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন চট্টগ্রামে।
কুকিরা দাবি করে, ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সৃষ্টি হয়েছিল কুকি বিদ্রোহের কারণে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পাহাড়ি এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কুকিরা স্থানীয় সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করে। কুকিদের এই আক্রমণে ১৮৬ জন ব্রিটিশ প্রজা খুন হয় এবং আটক হয় ১০০-এর অধিক। এছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপরও অত্যাচার করতে থাকে কুকিরা। প্রশাসনিকভাবে এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কুকিদের শায়েস্তা করার জন্য ব্রিটিশরা নানান আইন প্রণয়ন করতে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মূল বিরোধ হচ্ছে চাকমাদের সঙ্গে। খ্রিষ্টীয় ১৬০০ শতকের দিকে আগত কুকিরা পরবর্তী অনুপ্রবেশ করা চাকমা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রিটিশরা চাকমাদের সহযোগিতায় কুকিদের দেশান্তরিত করেছিল।
কুকিরা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা, কুকি মূলত কোনো একক নৃগোষ্ঠি নয়। প্রায় ৫০টি জাতিগোষ্ঠির সমন্বয়ে কুকি-চিন-মিজো জাতি গঠিত। এদের অধিকাংশ মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বসবাস করে, এদের বড় একটি নৃগোষ্ঠি ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ‘মিজো’ উপজাতি, যারা বাংলাদেশে বম, লুসাই ও পাংখোয়া নামে পরিচিত। ভারতেও কুকি জনগোষ্ঠির প্রায় ৫০টি শাখা রয়েছে যা তফশিলি সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত।
কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর পূর্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কুকিরা চীন, তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া হতে আগমন করে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পাহাড়ে বসতিস্থাপন করে। সেখান থেকে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি। বর্তমানে কেএনএফ দাবি করছে, রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। সেগুলো হলো বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। এই ছয়টি জাতি অধ্যুষিত রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠন করা হবে।
কুকি-চিন মানুষদের গত বছরের জানুয়ারি মাসে মিজোরামের রাজধানী আইজলে খুব উত্তপ্ত আন্দোলন হয়। সমগ্র মিজোরাম জুড়ে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে স্থানীয় মিজোরা বাংলাদেশের কুকি-চিনদের গুরুত্ব দিয়ে উদারভাবে আশ্রয় দিতে বলছিলো। মিয়ানমারের পালিয়ে আসা চিন জাতির জন্যও তারা একই নীতি চেয়েছিলো। কিন্তু সীমান্তরক্ষীরা কেন্দ্রীয় সরকার-নিয়ন্ত্রণে। ফলে সীমান্তে অন্য দেশের ‘জো’ রা বাধা পাওয়ায় আইজলের মানুষরা ক্ষুব্ধ। এর আগে অবশ্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে চিন থেকে প্রচুর জো মিজোরামে ঢুকে আছে।
‘মি-জো’ শব্দের অর্থ হলো ‘পাহাড়ের মানুষ’। সব জাতিসত্তা নিজেদের বলে ‘জো’। আইজলের মিজোদের বক্তব্য হলো কুকি-চিনরাও জো। সুতরাং তারা বিপদে পড়ে যদি মিজোরামে ঢুকে থাকে, তাহলে এদের তাড়ানো যাবে না। মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে চিন প্রদেশ থেকে প্রচুর জো মিজোরামে চলে আসে আছে। বান্দরবানের কাছাকাছি মিজোরামের জিলার নাম লঙ্গৎলাই। আর চিনের অংশ পালেতওয়া টাউনশিপের মাটুপি। কাছেই আরাকানের মংডু।
কেএনএফ সদস্যরা মিয়ানমারের চিন রাজ্যের ভিক্টোরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা দাবি করে। এরপর এই কেএনএফ তরুণ সদস্যরা আধিকতর প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশে গিয়ে ইনফেন্ট্রি কমান্ডো ও গেরিলা ট্রেনিংয়ে প্রশিক্ষিত হয়।
বর্তমানে কেএনএফ দাবি করছে, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংগঠন চাকমাদের সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বা জুম্মল্যান্ড লিবারেশন আর্মি (জেএলএ)-এর মতো জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি। কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে একটি অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের জন্যে স্বশাসিত টেরিটোরি বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য (অঙ্কিত মানচিত্রানুযায়ী) দাবি করছে। কেএনএফ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি। কারণ কেএনএফ বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ এখন এক আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি, রুমা এবং থানচিতে ৩টি ব্যাংক প্রকাশ্যে লুট করে ফের আলোচনায় আসে সংগঠনটি।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), ২০১৬ সালে সশস্ত্র গ্রুপটি তৈরি হয়। তবে ২০২২ সালের মে মাস থেকে তাদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে। এই সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যের সংখ্যা ৩ থেকে ৪ শতাধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এই সংগঠনের নেতা নাথান লনচেও বম-ই কেএনএফের প্রধান। রুমার এডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি এনজিও আছে তার।
শুরুতে এ সংগঠনের নাম ছিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স। প্রথমদিকে, তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করে এবং ভারতের মনিপুর ও বার্মার চিন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ২০২২ সালের মে মাসে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে কেএনএফ। কেএনএফ মনে পার্বত্য অঞ্চল সবচেয়ে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী তারা। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে, নিজেদের ক্ষমতার মূলধারায় অধিষ্ঠিত করতে, নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিতে, পাহাড়ে অধিপত্য বিস্তার করতে, রাষ্ট্রের সাথে দরকষাকষি করার ক্ষেত্র তৈরিতে, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে কুকি-চিন গোষ্ঠির তরুণরা। সংঘাতের এই যাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে পাহাড়ের সাধারণ জনজীবন বিপন্ন, দেশান্তর হওয়ার ভাবনায় আছে সেই অঞ্চলের বাকী নৃগোষ্ঠিগুলো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)