পিঠা বানানোর উৎসব। বাঁধভাঙা আনন্দ। ঢেকিতে কেউ চালের গুঁড়ি ভেঙেছেন তো অন্যদল পিঠা তৈরির পুর বানাতে ব্যস্ত, আবার কেউ রুটি বানিয়ে তার মধ্যে পুর ভরে নানা নকশার ছাঁচে ফেলেছেন পিঠা। আর অভিজ্ঞরা ভেজেছেন সেই পিঠা। বউমা-ভাবি-আপা-নাতবৌ মুহূর্তেই কত মধুর সম্বোধন পরস্পরের, কত চমৎকার আয়োজন। সেই পিঠা খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন সবাই। শীতের আগমনে যুগের পর যুগ বাঙালির প্রতিটি ঘরে পিঠা-পুলির এমন আয়োজনের চিত্র দেখা মিলে।
বাঙালির ঐতিহ্যের একটি অংশ হচ্ছে পিঠা। প্রতিটি পিঠায় থাকে প্রাণের ছোঁয়া, মিশে থাকে আবেগ যা পৃথিবীতে বিরল। গ্রামীণ পিঠার এমন আয়োজন গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় দাদী-নানী কিংবা মা-চাচীরা শিখে হরেক রকমের পিঠা বানিয়ে পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের জন্য ভালোবাসা দিয়ে পিঠা তৈরি করে খাওয়াতেন। তাছাড়া বাঙালিরা চিরকালই অতিথিপরায়ণ। সামাজিক বন্ধনটিও শক্ত। শীতের সময় দাওয়াত দিয়ে অতিথিদের পিঠা খাওয়ানো হবে না সেটি অনেক মায়েরা ভাবতেও পারেন না। অনেকে আবার বিভিন্ন পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন নিজের প্রতিভা তুলে ধরার জন্য।
তবে এই বিষয়টিকে ছাপিয়ে বর্তমানে পিঠা বানাতে পারা আর না পারা নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সরবভাবে দেখা যাচ্ছে পিঠা বানাতে পারা বা না পারা নিয়ে বির্তক। বেশিরভাগ নারী মনে করেন, পিঠা বানাতে পারা বা না পারা একজন নারীর পরিচয় হতে পারে না। মায়েরা-নানীরা সেসময় পিঠা বানাতো বলে বর্তমান প্রজন্মদেরও সেটিকে অনুসরণ করে স্বামী বা পরিবারের সবাইকে পিঠা বানিয়ে খাওয়াতে হবে বিষয়টি খুবই হাস্যকর। অনেকে আবার নিজেকে পিছিয়ে রাখতে চান না। তারা মা-শাশুড়ির কাছ থেকে শিখে কিংবা ইউটিউব দেখে পিঠা বানিয়ে খান। তবে স্ত্রী পিঠা বানাতে পারেন কি পারেন না সেই বিষয়টি নিয়ে শীতের সময়ে বেশ সরব থাকতে দেখা যায় পুরুষদের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পিঠা নিয়ে এমন যুদ্ধে অনেক নারীবাদী নিজের মন্তব্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘আজকাল মেয়েরা পিঠা বানাতে পারে না এটা শুনে অমনি আমাদের উচ্চশিক্ষিত, সচেতন কর্মব্যস্ত বুদ্ধিমান মেয়েরা পাগল হয়ে গেছে পিঠা বানানো পারা না পারা , কে বানাবে, কে বানাবে না এসব জিনিস নিয়ে।’ মেয়েদের উদ্দেশে তারা বলেন, ‘মেয়েরা তোমাদের এত সময় কেন? এত এনার্জি কেন? তোমরা কাদের বুঝাও? কেন বুঝাও? কী দরকার?’
এই পুরো বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, কোনো কিছু নিয়েই প্রভাবিত হওয়া ঠিক নয়। আমাদের সমাজে এখনো অনেকে এমন ধারণা পোষণ করে নারী বাইরে কাজ করবে না, কাজ করলেও রান্নাটা নারীকেই করতে হবে। ঘর-বাড়ি সামলানো নারীর কাজ, পুরুষরা এসব করে না। এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসলেই নারী পিঠা বানাতে পারে কি পারে না খুব ছোট বিষয়টি নিয়েই আর কথা হবে না।
তানিয়া হক মনে করেন, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু নিয়ে চাউর হলেই সবাই এটি নিয়ে পড়ে থাকে। সময়কে খুব ছোট বিষয়ে কাজে না লাগিয়ে ভালো কাজে দেওয়া ভালো।
সোশ্যাল মিডিয়া এখন বিনোদনের জায়গা হয়ে গেছে যে যাকে পাড়ছে তাকেই মজার পাত্র বানিয়ে নিচ্ছে এতে করে নারী পুরুষকে-পুরুষ-নারীকে অসম্মান করছে। আর এরকম চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মরা একটি নোরাং সমাজে বড় হয়ে উঠবে। ঠিক সেকারণে তানিয়া হকের পরামর্শ, বস্তুনিষ্টভাবে সবাইকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে। কারও অসম্মান ঘটে এমন কোনো কাজ থেকে নারী-পুরুষ সবাই বিরত থাকলে হয়তো কে পিঠা বানাতে পারে আর কে পারে না এমন হাস্যকর জিনিস নিয়ে কেউ কথা বলবে না।