মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইবাদতের জন্য। আল্লাহ তায়ালা দেখতে চান, কে তার ইবাদত করে, আর কে ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কে তার দেয়া অশেষ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জানায়, আর কে অকৃতজ্ঞ হয়ে স্রষ্টা মহান মালিককে ভুলে যায়। মূলতঃ কোন বান্দা কতটা আল্লাহভীরু সেটা দেখার জন্য মানুষকে এ পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীর নাজ-নেয়ামত দেয়া হয়েছে। ভোগ সামগ্রীর কোনো অভাব রাখা হয়নি। আল্লাহ তায়ালা পরখ করতে চান, বান্দা কি আল্লাহর ইবাদত-রিয়াজতে নিমগ্ন থাকে নাকি দুনিয়ার লোভ-লালসা, চাকচিক্যের মোহে ডুবে গিয়ে তার রবকেই যায়। এই পরীক্ষায় যে বান্দা উত্তীর্ণ হয়, তাকেই মুত্তাকী বলা হয়।
আর সেই ব্যক্তিই সফলকাম ও আল্লাহ তায়ালার কাছে মহা সম্মানিত ব্যক্তি। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচাইতে সম্মানিত সেই ব্যক্তিই, যে সবচাইতে বেশি খোদাভীরু’ (সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩)।
খোদাভীরুতার মূল ধারণাটি আসে ইবাদতের মাধ্যমে। ইবাদত যার যত, সে ততটাই খোদাভীরু। আর সেই ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম পূর্বশর্ত, ইমান বা আকীদা সঠিক থাকা। যার ইমান নেই, তার কোনো ইবাদত আল্লাহর কাছে দাম নেই। না সেই ইবাদতের বিনিময়ে আখেরাতে সে কোনো নেয়ামত পাবে, আর না সেটা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ইমানদার, তার আমল ততক্ষণই তার সহায়ক। ইমান সহকারে কৃত সেই আমল বা ইবাদতই তাকে জান্নাতে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
আল্লাহ তায়ালার বাণী: ‘যারা ইমান আনয়ন করেছে এবং অনুচিত বিষয়ের সাথে ইমানকে এক করে ফেলেনি, তাদের জন্যেই রয়েছে পরকালীন নিরাপত্তা। আর তারাই সুপথপ্রাপ্ত’ (সূরা আনয়াম, আয়াত: ৮২)।
ইমানের বিপরীত বিষয় হলো, শিরক ও কুফরি। এগুলো করলে ইমান চলে যায়। ইমান চলে যাওয়ার অর্থ আমলের চাকা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া।
সেকারণে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরি করেছে, তাদের সম্পদ, সন্তান-সন্ততি আল্লাহর দরবারে কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৬)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে: ‘আর যদি তারা শিরক করে, তবে তাদের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যাবে’ (সূরা আনয়াম, আয়াত: ৮৮)।
এতে পরিস্কার হলো, শিরক এবং কুফর এমন দুটি কাজ, যা বন্দার ইবাদতের বিনষ্টকারী। অতএব জানতে হবে, কোন কথা বা কাজটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। চিনতে হবে, কোন কথা বা কাজটি কুফরিভুক্ত। তা বুঝতে না পারলে ইমান সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব ব্যাপার। শুধু এই দুটি বিষয়ই নয়, বরং আরও জানতে হবে, কোনো কথা বা কাজ ভ্রষ্টতা ও বিদয়াতের অন্তর্ভুক্ত কিনা। কেননা হাদিস শরীফে ভ্রষ্টতা ও বিদয়াতের কারণে আমল বিনষ্ট হবার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য যে, যে শাস্ত্রে ইমানের পাশাপাশি শিরক, কুফর ও ভ্রষ্টতার মত বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়, তার নামই আকীদা।
আকীদা শব্দটি ইকদুন মূলধাতু থেকে নির্গত। বহুবচন আকায়েদ। যার অর্থ শক্ত করে বেঁধে রাখা বা গ্রন্থিবন্ধন করে রাখা। যেহেতু আকীদা চর্চার মাধ্যমে শক্তভাবে ইমানকে হৃদয়ে বেঁধে রাখা হয়, তাই একে এই নামেই নামকরণ করা হয়েছে। আকীদার ছয়টি ভিত্তি রয়েছে। আল্লাহর ইমান, নবী-রাসুলের প্রতি ইমান, আসমানী গ্রন্থসমূহে ইমান, ফেরেশতাদের প্রতি ইমান, তাকদীরের ভালো-মন্দ বিষয়ে ইমান ও আখেরাতের প্রতি ইমান। এই ছয়টি উসুলকে বিশ্লেষণ করাই মূলত আকীদার কাজ। এছাড়া ছয়টি মৌলিক বিষয়কে ব্যাখ্যা করাই আকীদা শাস্ত্রের কাজ। সাথেসাথে এসব বিষয়ে বিভিন্ন বাতিল ফির্কার ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডনও আকীদার আলোচ্য বিষয়বস্ত। কেননা ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে সঠিক বিশ্বাস চিহ্নিত করতে না পারলে ইমান হারানোর প্রবল আশংকা রয়েছে।
ইসলামের আকীদাসমূহের মধ্যে কিছু রয়েছে মৌলিক আকীদা। সেগুলো জরুরিয়্যাতে দ্বীন বা ইসলামের জরুরী বিষয় বলে গণ্য করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, এ বিশ্বাসগুলোর সাথে বৈপরীত্য করলে নিশ্চিতভাবে ইমান হারাবে।
যেমন: খতমে নবুওয়ত বা নবী কারিম (দ.) এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়টি। কেউ যদি বলে, এই যুগের আলেমরাই যুগের নবী; তবে একথাটি বলার কারণে সে ইমানহারা হবে। কেননা নবি কারিম (দ.) সর্বশেষ নবী। তার পরে কোনো নবী আসবে না। এ ব্যাপারটি জরুরিয়্যাতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।
এমনই আরেকটি বিষয় হলো, কোনো নবীকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন না করা। কেউ যদি বলে, ‘নবী আমার মত সাধারণ মানুষ। তিনি অমুক-তমুকের মতই জানতেন। এরচাইতে বেশিকিছু জানতেন না। তার মর্যাদা আর আমার মর্যাদায় কোনো তফাত নেই’। একথা বলার কারণেও সেই ব্যক্তি ইমানহারা হবে। কেননা নবি কারিম (দ.)-কে সম্মান করা ইমানের জরুরী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
আবার ইসলামী আকীদাসমূহের মধ্যে কিছু আবশ্যকীয় আকীদা রয়েছে, যা জরুরিয়্যাতে আহলে সুন্নাত নামে পরিচিত। সেগুলো বিশ্বাস না করলে ইমান চলে যাবে না, কিন্তু সেগুলোর অস্বীকার ভ্রষ্টতা বা বিদয়াতের দিকে নিয়ে যায়। তাই জরুরিয়্যাতে আহলে সুন্নাত সম্পর্কে অবগতি লাভ করে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তার বিপরীত বিষয়াবলি থেকে নিজেকে হেফাজত করা অত্যাবশ্যক।
যেমন: নবীগণ মাসুম। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তার সকল নবীকে গুনাহ, পাপাচার ইত্যাদি কলুষ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। এমনই আরেকটি আকীদা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার সকল নবীই রওজা শরীফে জীবিত। স্বাভাবিকভাবে ইন্তেকালের স্বাদ গ্রহণ করেন তারা। কোনো জিনিস মুখে দিলে তার স্বাদ যেমন অল্প কিছুক্ষণ মুখে লেগে থাকে, বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, ঠিক তেমনই নবীগণের ক্ষেত্রে মৃত্যুর স্বাদ হয়ে থাকে।
মৃত্যুর স্বাদগ্রহণের পর তা চলে যায় এবং তাদের দেহে আবারও প্রাণ ফিরে আসে। নবীগণ আপন আপন কবরে জীবিত বলেই মেরাজের রাতে নবি কারিম (দ.) এর পেছনে বাইতুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় করতে পেরেছেন। যেহেতু নামায শারিরীক ইবাদত। আর সেটা শারিরীক অস্তিত্ব এবং তার নড়চড় ব্যতীত আদায় করা সম্ভব নয়; বিধায় নবীগণ শরীরসহ কবরে জীবিত একথা যৌক্তিকভাবেও প্রমাণিত ও স্বীকৃত।
ইসলামী আকীদাসমূহের মধ্যে আবার এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো মতানৈক্যপূর্ণ। আহলে সুন্নাতের ইমামগণের মধ্যে সেসব বিষয়ে সম্মিলিত চূড়ান্ত সমাধান না হওয়ায় সেগুলো আবশ্যকীয় আকীদার মধ্যে ধর্তব্য নয়। মূলত এ বিষয়গুলো আলেমদের জন্য। তারা গবেষণা করে মানুষকে জানাবেন। মানুষ সে অনুযায়ী মান্য করবেন। তবে এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। সাধারণ মানুষের উচিত, এসব তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলে আবশ্যকীয় বিষয়গুলোকে ধারণ করা। একান্তই যদি কারো এসব বিষয়ে গভীরভাবে জানার আগ্রহ থাকে, তবে তিনি যেন আকীদার কিতাবাদী পড়াশোনা করেন এবং আলেমসমাজের সাহায্য নেন।
আকীদার বিষয়ে ইমামগণ তথা প্রাচীন-অর্বাচীন যুগের আলেমগণ বিভিন্ন কিতাব রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (র.) রচিত আল-ফিকহুল আকবর, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) এর আস-সুন্নাহ, ইমাম আশয়ারী(র.) রচিত আল ইবানাহ, ইমাম তাহাভী (র.) রচিত আল আকীদাতুত তাহাভীয়াহ, ইমাম তাফতাজানীর শরহুল আকাইদিন নাসাফিয়াহ ও ইমাম আহমদ রেযা (র.) রচিত আদ-দৌলাতুল মাক্কিয়্যাহ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো আকীদার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে সারাবিশ্বে পঠিত হয়। ইসলামের আকীদা কোনটি, আর কোনটি ভ্রান্ত মতবাদী কর্তৃক সৃষ্ট আকীদা, তা চিনতে এই গ্রন্থগুলো পাঠের বিকল্প নেই।
মোদ্দাকথা, আকীদার বিশুদ্ধতায় গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে যতটা দৃঢ় থাকা যায়, ইমান রক্ষা ঠিক ততটাই সহজ হয়। ইমানই যেহেতু ইবাদত-আমল টিকিয়ে রাখে, তাই সার্বক্ষণিক আকীদার বিশুদ্ধতা অর্জন জরুরী। তারপর সহি আকীদার মধ্য দিয়ে যে ইবাদত করা হবে, তা-ই আল্লাহর কাছে মকবুল হবে। অতএব ইবাদত কবুলের ক্ষেত্রে আকীদার বিশুদ্ধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।