সৌষ্ঠব ইবাদতের শামিয়ানায় মাহে রমজান। পবিত্র এ মাস হরেক ইবাদতের পসারা সাজিয়ে হাতছানি দেয় বারবার। বরকত-প্রাচুর্যের রমজান মাসে পল্লবিত ইবাদতের বিশেষ একটি ইবাদত হলো ইতিকাফ। মাহে রমজানের মাঝদশকের বিদায়ক্ষণে এবং শেষ দশকের শুরু-শেষ উভয় প্রান্তজুড়ে ইতিকাফের যাত্রা। এ সময় ইতিকাফ পালন করা সুন্নত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইতিকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামকেও উৎসাহিত করতেন। এর মাধ্যমে সুযোগ হয় আল্লাহর জিকির, ইবাদত-বন্দেগী, তেলাওয়াতে কুরআন, নামাজ, তসবি-তাহলিল ও ইবাদতের মাধ্যমে শবে কদরের সাক্ষাৎ।
আভিধানিক অর্থে ইতিকাফ মানে অর্থ হচ্ছে অবস্থান করা, নিবেদিত হওয়া, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা। সাধারণ দৃষ্টিতে ইতিকাফ হলো, পুরুষের জন্য নিয়তসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে অবস্থান করা। মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত কক্ষে বা স্থানে অবস্থান করা।
ইসলামি শরীয়তে তিন ধরনের ইতিকাফের কথা বিবৃত হয়েছে। যথা:
১. ওয়াজিব : ওয়াজিব ইতিকাফ হলো, মানতের ইতিকাফ; অর্থাৎ কেউ যদি মানত করে, ‘আমার কাজটি যথাযথ আদায় হলে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইতিকাফ করব।’ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে গেলে অবশ্যই ইতিকাফ করতে হবে। এই ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। রোজা ছাড়া এটি আদায় হবে না।
২. সুন্নতে মুয়াক্কাদা : সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ হলো, মাহে রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। প্রতিটি জুমা মসজিদে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে কমপক্ষে একজন হলেও এ প্রকারের ইতিকাফ পালন করতে হবে। অন্যথা পুরো এলাকাবাসী গোনাহের শামিল হবে। এটি মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া।
৩. মুস্তাহাব : মুস্তাহাব ইতিকাফ হলো, কিছুক্ষণের জন্য ইতিকাফের নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান করা।
ইতিকাফ পালনের জন্য সর্বোত্তম স্থানের মধ্যে ১. মসজিদুল হারাম, ২. এরপর মসজিদে নববি, ৩. এরপর বায়তুল মুকাদ্দাস, ৪. এরপর জামে মসজিদ, ৫. এরপর যে মসজিদে মুসল্লি সংখ্যা বেশি হয়, ৬. মহিলারা অবশ্যই নিজেদের বাসাবাড়িতে নামাজের স্থানে ইতিকাফ করবেন।
ইতিকাফের শর্তাবলি : ১. নিয়ত করা। নিয়ত ছাড়া কখনো ইতিকাফ আদায় হবে না। ২. এমন মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নিয়মিত জামাত হয়, ৩. নির্দিষ্ট ইমাম ও মুয়াজ্জিন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাত আদায় করে, ৪. এমন মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না, ৫.ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমান হওয়া এবং ৬.মহিলা অপবিত্রতা ও হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া। মনে রাখতে হবে ইতিকাফের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত নয়। তাই ছোটরাও ইতিকাফ করতে পারবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে।
পুরুষরা জরুরী প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হবেন না। অপ্রয়োজনে কেউ মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে প্রস্রাব, পায়খানা এবং জামে মসজিদে জুমার উদ্দেশ্যে বের হওয়া যাবে (রদ্দুল মুহতার, খ.৩, পৃ.৫০১)।
অনুরূপভাবে মসজিদ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে কিংবা জোরপূর্বক কেউ মসজিদ থেকে বের করে দিলে তখন অন্য মসজিদে গিয়ে অবস্থান করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না (ফতোয়া-ই আলমগীরী, খ.১, পৃ.২১২)। স্বপ্নদোষের দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হয় না। তবে সহবাসের দিকে উৎসাহ করে, এমন কাজ দিন-রাতের যে কোনো সময় সংঘটিত হলে, ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে (ফতোয়া-ই আলমগীরী, দুররুল মুখতার, খ.১, পৃ.২১১)।
ইতিকাফ পালন করা অবস্থায় করণীয় : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাত সহকারে আদায় করা। পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াত করা। অধিকহারে দরূদ শরিফ পাঠ করা। জিকির-আজকার করা। ধর্মীয় পুস্তকাদি পড়া। ইলমে দ্বীন অর্জন ও মাসআলা-মাসাইল জানা।
ইতিকাফ রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি ধারাবাহিক সুন্নাত। মুমিন জননী হযরত আয়িশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ পালন করতেন’ (সহীহ মুসলিম শরিফ, হাদিস নং—১১৭২)। তাই, ফজিলতপূর্ণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণীয় উত্তম আদর্শের সুমহান এই সুন্নাতে মুবারকা পালন ও এর চর্চা মুসলিম সমাজে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আরও বহুল প্রচার-প্রসার হোক।