প্রথম রাউন্ডের লড়াই দিয়ে রোববার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের পর্দা উঠেছে। সাতটি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ২০ ওভারের ক্রিকেটের রোমাঞ্চকর যাত্রা। সাউথ আফ্রিকায় বসেছিল প্রথমটি। চতুর্থটি বসেছিল শ্রীলঙ্কায়। ঘটনাবহুল আর উত্তেজনায় ঠাঁসা প্রতিটি আসরের স্মৃতি তুলে আনছে চ্যানেল আই অনলাইন। এপর্বে থাকছে ২০১২ মহাযজ্ঞের স্মৃতিগাঁথা।
টি-টুয়েন্টি চার-ছক্কার মেলা। দ্রুত রান তোলা ব্যাটারদের কদর বেশ। অন্য দুই ফরম্যাটের তুলনায় তাই ২০ ওভারের ক্রিকেটে তুলনামূলক শক্তিশালী দল হিসেবেই পরিচিতি রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দানবীয় সব ব্যাটার নিয়ে সাজানো থাকে ক্যারিবীয় লাইনআপ। নিজেদের শক্তির ফরম্যাটে অবশ্য প্রথম তিন আসরে ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারেনি উইন্ডিজ। ২০১২ বিশ্বকাপে এসে খোলে গেরো। ড্যারেন স্যামিরা সামর্থ্যের জানান দিয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন।
যাত্রার তিন আসর পর প্রথমবার এশিয়ার মাটিতে বসে টি-টুয়েন্টির বিশ্বআসর। পাকিস্তানে ক্রিকেটারদের ওপর হামলার পর উপমহাদেশীয় যেকোনো আসরে নিরাপত্তা তখন স্বাগতিকদের মূল মাথাব্যথা। এককভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রথম পদক্ষেপে কমতি রাখতে চায়নি স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। শুরু থেকেই নিরাপত্তার ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে নজরে রাখে লঙ্কান বোর্ড। বিপত্তি বাধে আসরের তিন মাস আগে। বিশ্বকাপে নিরাপত্তার বিষয়টি নজর রাখতে একজন পরামর্শদাতা নিয়োগ দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। শেষদিকে হুট করেই উধাও হয়ে যায় সেই পরামর্শকের সব কাগজপাতি।
গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসে, ডকুমেন্টগুলো চুরি হয়েছে খোদ বোর্ড হেডকোয়ার্টারের অফিস থেকে। ঘটনার পর নিরাপত্তার ব্যাপারটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আবারও। শেষপর্যন্ত লঙ্কান বোর্ডের প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে অবশ্য বিশ্বকাপ চালিয়ে নিতে সম্মত হয় আইসিসি।
বিশ্বকাপের পাঁচ মাস আগে সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সেই সফরে টিকিটের দাম নিয়ে প্রশ্ন ছিল ইংলিশ সমর্থকদের। বিশ্বকাপের সময় আক্ষরিক অর্থেই পানির দামে টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আইসিসি। মাত্র ০.২৫ ডলারে গ্রুপপর্বের সব ম্যাচের টিকিট কিনতে পেরেছিল দর্শকরা। আয়োজনে আইসিসির কাছ থেকে মোট সাড়ে তিন মিলিয়ন অর্থ পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা।
তারকাদের আগমন-বিদায়
৬২ গড়ে ২৪৮ রান করে ২০১০ সালে ইংল্যান্ডকে টি-টুয়েন্টির শিরোপা জিতিয়েছিলেন কেভিন পিটারসেন। ফর্মে ছিলেন এবারও। বোর্ডের সাথে অভিমান করে বিশ্বকাপের ঠিক আগে সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে সরে যান। দীর্ঘ বিরতির পর বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তান ওপেনার কামরান আকমল। ক্যান্সার থেকে সেরে উঠে এ আসরে আবারও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান ভারতের যুবরাজ সিং।
এশিয়ায় বিশ্বকাপ, স্পিন শক্তি বাড়াতে চেষ্টা করে অস্ট্রেলিয়া। চার বছর আগে অবসর নেয়া ব্র্যাড হগকে এসময় দলে ফেরায় সংস্করণের বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। বিশ্বকাপেই প্রথমবার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে দলে টানে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। তবে স্কোয়াডে খুব একটা পরিবর্তন আনেনি বাংলাদেশ। নাজমুল হোসেনকে সরিয়ে স্কোয়াডে জায়গা করে নিয়েছিলেন ফরহাদ রেজা।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বড় জয় দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে এসে খেই হারিয়ে ফেলে তারা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে সাউথ আফ্রিকার কাছে ৩২ রানে হারে মাহেলা জয়াবর্ধনের দল। শক্তিশালী শ্রীলঙ্কান ব্যাটিং লাইনের সামনে লক্ষ্যটা ছিল ৭ ওভারে ৭৮ রানের। স্বাগতিকদের বিপর্যয় মানতে পারেনি দ্বীপ দেশটির সমর্থকরা। ম্যাচ শেষে টিম বাসে তারা হামলা করে বসে ক্ষুব্ধ হয়ে।
ঘটনার পর খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিয়ে আবারও নড়েচড়ে বসে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট। নিয়ম করা হয়, যেসব হোটেলে খেলোয়াড়রা থাকবেন, সেখানে বাইরের কোনো অতিথি থাকতে পারবেন না। হোটেলের বাইরে সার্বক্ষণিক পাহাড়ায় থাকবে পুলিশের একটি দল। সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় খেলোয়াড়দের মাঠে আনা-নেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করে বোর্ডটি।
সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ
১২ দলকে চার গ্রুপে ভাগ করে শুরু হয় মহাযজ্ঞ। নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের সাথে একই গ্রুপে পড়ে বাংলাদেশ। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে গ্রুপপর্বের একটি ম্যাচেও লড়াই জমাতে পারেনি টাইগাররা।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে এক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাছেই হেরেছে মুশফিকুর রহিমের দল। ড্যাশিং ওপেনারের ১২৩ রানের ইনিংসে ১৯১ রানের বিরাট সংগ্রহ পায় কিউইরা। ব্যাট করতে নেমে কাইল মিলস ও টিম সাউদির তোপে লড়াইয়ে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ। শেষদিকে নাসির হোসেনের ৫০ রানের ইনিংসে কিছুটা প্রতিরোধ দেখাতে পারলেও ৫৯ রানের হারে টুর্নামেন্ট শুরু করে লাল-সবুজের দল।
দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে কিছুটা লড়াইয়ের আভাস দিয়ে হারেন সাকিব-তামিমরা। শুরুতে ব্যাটিং করে সাকিব আল হাসানের হার না মানা ৮৪ রানের ইনিংসে ১৭৫ পুঁজি পায় বাংলাদেশ। ইমরান নাজির ও মোহাম্মদ হাফিজের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৮ বল বাকি থাকতে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় পাকিস্তান।
দুই ম্যাচের দুটোতেই হেরে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ে বাংলাদেশ। দাপুটে পারফরম্যান্সে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। এক ম্যাচ হারলেও সুপার এইটে ঠিকই জায়গা করে নেয় কিউই দল।
দুম্যাচের দুটো জিতে সুপার এইটে ওঠে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতও। ভারতের বিপক্ষে হারলেও আফগানিস্তানকে উড়িয়ে সুপার এইট নিশ্চিত করে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। বাকি দুই গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ আফ্রিকা। একটি করে জয় নিয়ে সুপার এইটের টিকিট কাটে দুই ফাইনালিস্ট শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের মতো দুটো ম্যাচ হেরে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ে আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও আফগানিস্তান।
সুপার এইটে দলগুলোকে আবারও দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত পাকিস্তানের সাথে একই গ্রুপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ আফ্রিকা। স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার গ্রুপে জায়গা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের।
গ্রুপপর্বে কিছুটা নড়বড়ে লাগলেও সুপার এইটে নিজেদের সেরাটা মেলে ধরতে শুরু করে শ্রীলঙ্কা, যার শুরুটা হয় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর ম্যাচের মধ্য দিয়ে। কিউইদের ১৭৫ রানের লক্ষ্যে শেষ বলে ১ রান দরকার ছিল স্বাগতিকদের। লাহিরু থিরিমান্নের রানআউটে টুর্নামেন্টে প্রথমবার ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।
এক ওভারের লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু করে মাহেলা জয়াবর্ধনের দল। আত্মবিশ্বাসী স্বাগতিকরা সুপার এইটের বাকি দুই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডকে তেমন একটা পাত্তাই দেয়নি। শেষ ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ১৯ রানে হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনালের টিকিট কাটে।
বাংলাদেশকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা নিউজিল্যান্ডের সুপার এইট কেটেছে হতাশায়। সেরাদের লড়াইয়ে একটি ম্যাচেও জয় পায়নি ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল। কিউইদের তিনটি ম্যাচের দুটিই গড়ায় সুপার ওভারে। এক ওভারের লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও জয় পায়নি ওশেনিয়ার দেশটি। কিউইদের হারিয়ে আত্মবিশ্বাসী ক্যারিবীয়রা ইংল্যান্ডকে হারায় ১৫ রানে। দুই জয় নিয়ে তারাও জায়গা করে নেয় সেরা চারের লড়াইয়ে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সান্ত্বনার জয় পেলেও সুপার এইট থেকে ছিটকে যায় ইংলিশরা।
ভারত পাকিস্তানের গ্রুপেও লড়াই হয় বেশ। দুটি ম্যাচ জিতেও রানরেটে কপাল পোড়ে ভারতের। সমান দুটি করে ম্যাচ জিতে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে জায়গা পেয়ে যায় পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া। নিউজিল্যান্ডের মতোই সুপার এইটে একটিও জয় পায়নি সাউথ আফ্রিকা।
কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে প্রথম সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। এশিয়ান দুই জায়ান্টের লড়াইটা হয় লো-স্কোরিং। সোহেল তানভীর-শহীদ আফ্রিদিদের কিপটে বোলিংয়ে শুরুতে ব্যাট করে ১৩৯ রানের বেশি যেতে পারেনি স্বাগতিকরা। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তিলকারত্নে দিলশান ৪৩ বলে ৩৫ রান করেন। মাঝারি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে সাবধানে এগোয় পাকিস্তান। অজন্তা মেন্ডিস ও রঙ্গনা হেরাথের ঘূর্ণির সামনে মিডল ওভারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তারা। ১৬ রানে হেরে বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয় মোহাম্মদ হাফিজের দলের।
ফাইনালে ওঠার আরেক লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়াকে পাত্তাই দেয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরুতে ব্যাট করে ক্রিস গেইল ও কাইরেন পোলার্ডের বিধ্বংসী ইনিংসে ২০৫ রানের বিরাট সংগ্রহ পায় ক্যারিবীয়রা। জবাব দিতে নেমে কোনো লড়াই করতে পারেনি পাঁচবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নরা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো অজিদের ইনিংস থামে ১৩১ রানে। ৮৪ রানের বিশাল জয় নিয়ে ফাইনালে ওঠে ড্যারেন স্যামির দল।
অক্টোবরের ৭ তারিখ প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ফাইনালের লড়াইয়ে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কা। চেনা কন্ডিশনে উইন্ডিজের থেকে বেশ এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা টস হেরে শুরুতে বোলিংয়ে নামে। আগের ম্যাচে চার-ছক্কার ফোয়ারা ছোটানো গেইল-পোলার্ডরা এদিন অজন্তা মেন্ডিসের বল বুঝতেই পারলেন না। ৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ক্যারিবীয়দের পথ দেখান মারলন স্যামুয়েলস। উইকেটের এক পাশে যখন আসা-যাওয়ার মিছিল, একাই লড়াই করে যান ডানহাতি ব্যাটার। স্যামুয়েলসের হার না মানা ৭৮ রানে ভর করে ২০ ওভারে ১৩৭ রান তোলে উইন্ডিজ।
মাঝারি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে স্বাগতিকদের এমন দশা হবে হয়ত ভাবেননি কেউই! পুরো টুর্নামেন্ট উড়ন্ত ফর্মে থাকা দিলশান-সাঙ্গাকারাদের কেউই ফাইনালে কিছু করে দেখাতে পারলেন না। এক সুনীল নারিনের ঘূর্ণির সামনে যেন দাঁড়াতে পারলেন না কেউ। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১০১ রানে স্বাগতিকদের গুঁড়িয়ে দেয় স্যামির দল। যার মধ্য দিয়ে টি-টুয়েন্টি চ্যাম্পিয়নদের তালিকায় নতুন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম যুক্ত হয়ে যায়।