প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। নতুন দেশে গিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে নতুন নতুন ভাষা শিখতে, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয় বটে কিন্তু নিজ মাতৃভাষার প্রতি, শেকড়ের প্রতি তারা আমৃত্যু গভীর টান অনুভব করেন।
তাই প্রবাসীদেরকে দেখা যায় সারা বছর জুড়ে তারা প্রাণের টানে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা, ঈদ, পিঠা উৎসব,পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।
তেমনই একজন প্রবাসী-মা-সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ড. জেবুন্নেসা চপলা, যিনি প্রায় বিশ বছরের অধিক সময় ধরে প্রবাসে বসবাস করছেন। তিনি বর্তমানে কানাডার ক্যালগেরিতে বসবাস করছেন। কিন্তু পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে সুইডেন, নরওয়ে এবং কানাডার সাস্কাচুয়ানে। ড. জেবুন্নেসা একজন একনিষ্ঠ কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, পোস্টডক গবেষক, ক্যালগেরির মাউন্ট রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
তিন সন্তানের জননী চপলার মেয়েদের জন্ম আমেরিকার নিউয়র্ক, নিউজার্সি এবং কানাডার সাস্কাটুনে। তাদের নাম প্রার্থনা, প্রকৃতি এবং পৃথিবী যারা বেড়ে উঠেছে বাংলা ভাষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সংস্পর্শে। প্রবাসের মাটিতে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দেওয়া, শিশুদের বাংলা ভাষায় কথা বলা, নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ছড়িয়ে দিতে পরিবারের এবং কমিউনিটির ভূমিকা কতোটুকু এই নিয়ে সম্প্রতি ড. জেবুন্নেসা চপলা কথা বলেন চ্যানেল আই অনলাইন-এর সঙ্গে।
ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা শেখার ব্যবস্থা
অনেকটা আক্ষেপের সুরে ড: চপলা জানালেন, দেশে ফোন দিয়ে বাংলায় কথা বলা ছাড়া আর কোনো সুযোগ ছিল না বাংলা চর্চার। এই চারজনের সাথে তাদের দেখা হওয়ার সুযোগও থাকতো কম। ২০০৩ সালে সুইডেনে যখন লেখাপড়া করি তখন গোথেনবার্গ ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছিল মাত্র চারজন।২০০৫ সালে যখন তিনি নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছিলেন তখন সেখানে মাত্র ১২ থেকে ১৪ জন বাঙালি শিক্ষার্থী ছিল। আমি নরওয়ের বার্গেন শহরে জাতিসংঘের একটা সংস্থার সাথেও জড়িত ছিলাম। ২০০৬ সালে তাদের একটা প্রোগ্রামে তিনি অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসের কথা ভিনদেশিদের কাছে নরওয়ের মিডিয়াতে তুলে ধরেছিলাম। সেই সময়ে বিদেশের মাটিতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস খুব কম মানুষই জানতো।
চপলা বলেন, এরপর ২০১০ সালে যখন আমি নর্থ আমেরিকায় আসি অভিবাসী হিসেবে তখন সেখানে দেখা মেলে অগণিত বাঙালির সাথে। প্রবাসে বাংলা শেখানোর তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, কিছু অনিয়মিত বাংলা স্কুল ছাড়া যদিও কানাডা বহু সাংস্কৃতিক দেশ হবার কারণে নিজ মাতৃভাষা চর্চার অনেক সুযোগ প্রদান করে যাচ্ছে।এখানকার বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনে যারা যুক্ত আছেন তারা একুশে ফেব্রুয়ারী এবং অন্যান্য জাতীয় দিবস উদযাপনের যথেষ্ট চেষ্টা করেন। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন, ছোট্ট শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবই করে থাকেন, কিন্তু নিয়মিত বাংলা ভাষা শিখিয়ে যাওয়াটা খুব চ্যালেঞ্জিং তাদের জন্য যদিও এখানে বাঙালি কমিউনিটি সংখ্যায় অনেক বড়।
কমিউনিটি রেডিও দিয়ে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দিয়েছি
জেবুন্নেসা চপলা বলেন, ২০১০ সালে সাস্কাটুনে যখন কমিউনিটি রেডিওতে কাজ করার সুযোগ তৈরি হলো তখন আমার নতুন করে বাঁচার তাগিদ তৈরি হলো। কারণ এরআগে আমার মনে হয়েছিল শিল্পী হিসেবে আমি মৃত, মানুষ হিসেবে আমি মৃত। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আমি আমার জাতিসত্ত্বাকেও ধরে রাখতে পারব না। আমি কমিউনিটি রেডিওতে কাজ করে আর্থিক কিছুই পাইনি, গাড়ির তেল খরচও পাইনি।ভোর ছয়টায় উঠে বরফে ঢাকা শহরে বের হয়ে যেতাম, কখনো মাইনাস থার্টি কখনো বা মাইনাস ফোর্টি তাপমাত্রায় বের হয়েছি। নিজে শিক্ষার্থী ছিলাম, নিজের ছোট্ট বাচ্চা ছিল। তবে আমি বাংলাভাষাকে কমিউনিটির মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে পেরে যে মানসিক শান্তি পেয়েছি সেটা বলে বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। রক্ত দিয়ে যারা বাংলা ভাষা আমাদের উপহার দিয়ে গেল তাদের জন্য বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে এটা ছিল আমার যুদ্ধ। এমনটাই ব্রত নিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলার গান ও কথা’র জন্ম ২০১২ সালে। প্রবাসী বাঙালি হিসেবে শেকড়ের সাথে সংযুক্ত থাকবার জন্য এবং বাংলাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবার জন্য গত এক যুগ ধরে ‘বাংলার গান ও কথা’ কমিউনিটির সজীব দৃষ্টি ভঙ্গির সদস্যদের সহযোগিতায় অবিরাম কাজ করে গেছে। আমি, আমার স্বামী এবং কমিউনিটির কিছু তরুণদের সহযোগিতায় গত ১২ বছরে প্রায় ৪০০ এর বেশি অনুষ্ঠান করেছি।
প্রবাসী অনেক সন্তানেরা বাংলা জানেই না!
‘‘প্রবাসের মাটিতে যখন আমি বাঙালিদের দেখি তাদের সন্তানরা বাংলা ভাষা পারে না, জানে না আমি বিস্মিত হই, বাংলা আমার কাছে অক্সিজেন। তারাতো তাদের সন্তানদের অক্সিজেন দিচ্ছেন না’’ —বলছিলেন জেবুন্নেসা চপলা। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকাংশ সন্তানেরা জানেনা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের নাম এবং বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস। অনেক বাবা-মা আছেন যারা একটি বারের জন্যও বাসায় বাংলায় কথা বলেন না।ওরা যেহেতু বাংলা ভাষাই জানে না, তাহলে কীভাবে বাংলা ভাষার ইতিহাস জানবে? খুব আফসোস হয় ওদের অভিভাবকদের জন্য। আমি বেশকয়েকজন সাংস্কৃতিককর্মী, আবৃত্তি শিল্পী, নৃত্যশিল্পীদের যেখেছি যারা নিজেরা বাংলা ভাষায় সুশিক্ষিত হয়েও নিজেদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখায়নি নানাবিধ কারণে।কিন্তু আমি আমার সন্তানদের শিখিয়েছি দায়িত্ব হিসেবে। দ্বিতীয় প্রজন্মকে বাংলা শেখানো এটা কিন্তু একক দায়িত্ব নয়, আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমি এখনো এখানকার কমিউনিটির বাচ্চাদের বাংলা ভাষায় গান কবিতা শিখিয়ে যাচ্ছি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। এটা আমার প্রাণের তাগিদ থেকে করি, নিজের দায়িত্ববোধ থেকে করি।
মা হিসেবে আমার দায়িত্ব থেকে সরে যাইনি
‘‘চোখের সামনে আমার তিনটি মেয়ে প্রার্থনা, প্রকৃতি এবং পৃথিবী বড় হয়ে গেল। ওদের জন্ম নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও সাসকাটুনে। দেশের বাইরে ওদের জন্ম হলেও ওরা খুব ভালো বাংলা বলতে ও লিখতে পারে’’ —গর্বিত ভরাট কণ্ঠে বললেন জেবুন্নেসা চপলা।
কমিউনিটির অনেকেরই প্রশ্ন ওরা কিভাবে এত সুন্দর বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে? অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ওদের শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ শুনে। মনটা ভরে যায় যখন সকলেই ওদের প্রশংসা করে। নিজের প্রতি আমার নিজের প্রতিজ্ঞা এবং সন্তানদের নিয়মিত চর্চায় আমি পুরোপুরি সফল।
চপলা জানালেন, আমার মেয়েরা এখন অনর্গল বাংলা বলতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে এবং হৃদয়ে বাংলা ও বাংলাদেশকে অনুভব করতে পারে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের হাত ধরে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে একান্ত পারিবারিক প্রচেষ্টায় ও সাধনায় । তবে কমিউনিটি রেডিওর অনুষ্ঠানটি যদি চালিয়ে না যেতাম এবং বাড়ীতে অন্যান্য বাচ্চাদের যদি নিয়মিত না শেখাতাম তাহলে কেমন করে আমাদের মেয়ে তিনটিকে বাংলা শেখাতাম আমি জানি না।
পরিবার ও কমিউনিটির সচেতনা জরুরি
নতুন প্রজন্ম যেখানেই বেড়ে উঠুক পারিবারিকভাবে বাংলা শিক্ষাটা জরুরি, পরিবারের সচেতনা জরুরী এবং বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম এমনটাই বললেন জেবুন্নেসা চপলা। এরপর কমুনিটির বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা তো রয়েছেই। সন্তানের মুখে মাতৃভাষাকে তুলে দিতে একজন মাকে হতে হবে দেশপ্রেমী, সচেতন, কবিতা প্রেমী, নৃত্য ও সঙ্গীতানুরাগী আর সর্বাগ্রে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হওয়া এবং সে চেতনাবোধকে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দেবার দৃঢ় সঙ্কল্প সকলের নিজ নিজ হাতের প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখা খুব দরকার আর সেটাইতো মায়েদের দায়িত্ব।
প্রাণের তাগিদে,সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করি
ড. চপলা বলেন, অভিবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে, নতুন পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সাথে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াবার জন্য এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক শিক্ষার সাথে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার জন্য, দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে দেবার জন্য এবং অবাঙালিদের মাঝে বাংলাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য নিভৃতে, নিরলস কাজ করছি।কমিউনিটি রেডিও, কমিউনিটি গার্ডেন এবং আন্তঃ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষনীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কাজগুলো করে যাচ্ছি শুধুমাত্র প্রাণের তাগিদে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে।গত ১২ বছরের বেশি সময় ধরে নেসক্রিক নামক একটি মিউজিক ফেস্টিভ্যালে কালচারাল কানেকশন বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছি যেখানে বহু সাংস্কৃতিক দলগুলোর পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরছি ক্লান্তিহীন ভাবেই। শুধুমাত্র নেস ক্রিক নয় আমি এবং আমার পরিবার অগণিত মাল্টিকালটারাল ফেস্টিভ্যালে বাংলার শিল্পকে তুলে ধরবার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
সাস্কাটুন শহরে ১০ বছর বসবাসের পর নতুন শহর ক্যালগেরিতে পূর্ণ উদ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি বলে চপলা বললেন: এবার রেডিওতে নয় তিনি নিজ বাড়িতে শিশু-কিশোরদের ছড়া, কবিতা, গান, গল্প শিখিয়ে যাচ্ছেন এবং ক্যালগেরি কমিউনিটির বিভিন্ন মাল্টিকালচারাল এবং বাঙালি অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত।
জেবুন্নেসা চপলা ২০১৫ সালে ‘‘কমিউনিটি লিডারশিপ, সোশ্যাল একটিভিজম এবং ভলান্টিয়ারিসম’’ ক্যাটাগরিতে বাঙালিদের জন্য এক বিরল সম্মান এনে দিয়েছেন ‘সিবিসি সাসকাচুয়ানের ভবিষ্যতের ৪০ কমিউনিটি লিডার সম্মাননা’ প্রাপ্তির মাধ্যমে। তার সকল প্রচেষ্টাকে সম্মাননা জানিয়েছে মাল্টিকালটারাল কাউন্সিল অফ সাস্কাচুয়ান, গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (জিএসএ) ইউনিভার্সিটি অফ সাস্কাচেওয়ান, বিবিসি বাংলা এবং বাংলাদেশী কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন অফ সাস্কাচেওয়ান (বিকাশ)।